আগের তিনটি পর্বে হিন্দুশাস্ত্রে বর্ণিত পাপগুলোর ১ থেকে ৩৬ পর্যন্ত আলোচনা করেছি, এই পোস্টে বাকিগুলোর আলোচনা করছি:
হিন্দুশাস্ত্রে বর্ণিত ৩৬ নং উপপাপে বলা হয়েছে, ‘অসৎশাস্ত্রাভিগমন’ অর্থাৎ পাপজনক শাস্ত্রের অনুশীলন।
এটা তো সত্য যে, আপনি যে গাছের বীজ মাটিতে রোপন করবেন, সেই গাছের চারাই গজাবে এবং পরবর্তীতে সেই গাছের ফলই লাভ করবেন। কোনো মানুষ যখন- চোর, ডাকাত বা লুটেরা হয়, সে কিন্তু একদিনে তা হয় না, দীর্ঘদিনের একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়ার ফলে সে তাতে রূপান্তরিত বা পরিণত হয়।
কথায় বলে, “চুরি বিদ্যা বড় বিদ্যা, যদি না পড়ে ধরা”, তার মানে চুরিও একটি বিদ্যা। এখন আপনি যদি আপনার সন্তান বা শিষ্যকে চুরি করা শেখান, বড় হয়ে সে তো চুরিই করবে, চুরি বিদ্যা শিক্ষা দিয়ে তার কাছ থেকে তো আপনি সাধুতা আশা করতে পারেন না। এজন্যই পাপজনক শাস্ত্রের অনুশীলন করাকে হিন্দু শাস্ত্রে পাপ বলে গণ্য করা হয়েছে, যাতে সেই ধরণের বিদ্যা কেউ অর্জন না করে এবং অপরকে তা শিক্ষা না দেয় এবং এই ভাবে আমাদের মুনি-ঋষিরা সমাজকে দূষিত হওয়া থেকে বাঁচানোর পথ দেখিয়ে দিয়ে গেছেন।
ব্যক্তিমতের ধর্মগুলোতে আপনি হয়তো এই বিধান পাবেন যে, চুরি করা পাপ; কিন্তু চুরি করা শেখানো পাপ, এমন বিধান আপনি কোথাও পাবেন না। তার মানে ব্যাপারটা এমন, কেউ যখন চুরি করে ধরা পড়বে, তখন তাকে সেই ধর্মের বিধান শাস্তি দেবে; কিন্তু যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সে চোর হয়ে উঠলো, সেই প্রক্রিয়াকে সেই ধর্মীয় বিধান দায়ী করবে না এবং এ ব্যাপারে সেই বিধানের মাথা ব্যথাও নেই। এজন্যই সমাজে অপরাধীর শাস্তি হলেও অপরাধ কমে না; কারণ, এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হয়তো বিষবৃক্ষের ডালপালা ও পাতা ছাঁটা হয়, কিন্তু সেই বিষবৃক্ষটি কেনো এবং কিভাবে বেঁচে থেকে ডালপালা ও পাতার জন্ম দেয়, সেই ব্যাপারে কোনো নজর দেওয়া হয় না; তাই সমাজ থেকে অপরাধ দূরও হয় না। কিন্তু হিন্দু মুনি-ঋষিরা সমাজ থেকে অপরাধ দূর করার পাশাপাশি, নতুন অপরাধী যাতে তৈরি না হয়, সে ব্যবস্থাও করে গেছেন, একারণেই হিন্দু ছেলে মেয়েরা, যেকোনো মুসলিম ছেলে মেয়ের চেয়ে মনে প্রাণে সৎ এবং আদর্শবাদী।
More Read: শিশুর স্মার্টফোন আসক্তি কমানোর ৪ উপায়
যা হোক, এরপর ৩৭ নং উপপাপে বলা হয়েছে, ‘কৌশীলব্যাক্রিয়া’ অর্থাৎ নটিবৃত্তি।
আপনারা ‘নটী’ শব্দের সাথে নিশ্চয় পরিচিত। গ্রাম বাংলায় এই শব্দটি মেয়েদের উদ্দেশ্যে একপ্রকার গালি হিসেবে ব্যবহার করা হয় এবং এর সরল মানে হচ্ছে বেশ্যা; অর্থাৎ যে মেয়ে যৌনপেশায় বা দেহ ব্যবসার কাজে নিয়োজিত। স্ত্রীলিঙ্গ হিসেবে ‘নটী’ শব্দটির উৎপত্তি ‘নট’ শব্দ থেকে, আর ‘নট’ শব্দের মানে হচ্ছে যেব্যক্তি নাটকে অভিনয় করে অর্থাৎ অভিনেতা।
নাটক যখন প্রথম অভিনীত হওয়া শুরু হয়, সেটা কোলকাতায় ১৮০০ সালের দিকেই হোক বা প্রাচীন গ্রীসে খ্রিষ্টপূর্ব সময়েই হোক, তখন নাটকে নারী চরিত্রের অভিনয়ের জন্য কোনো মেয়ে পাওয়া যেতো না; কারণ, ভদ্র ঘরের কোনো মেয়েই নাটকে অভিনয় করতে চাইতো না বা অভিনয় করতে আসতো না। সেই সময় পুরুষদেরকেই মেয়ে সাজিয়ে নারী চরিত্রে অভিনয় করানো হতো। কিন্তু আদিম পেশা হিসেবে দেহ ব্যবসা তো সভ্যতার শুরু থেকেই আছে, আর যারা দেহ ব্যবসার সাথে যুক্ত তাদের তো মান সম্মানের কোনো বালাই কখনোই ছিলো না বা এখনও নেই। তাই নারী চরিত্রকে বাস্তব করে তোলার জন্য নাটকের পরিচালকরা পতিতালয় থেকে মেয়েদের ধরে নিয়ে এসে নাচ গান শিখিয়ে নাটকে অভিনয় করাতে শুরু করে। এভাবে পুরুষ অভিনেতার সমর্থক শব্দ ‘নট’ থেকে স্ত্রীলিঙ্গ হিসেবে ‘নটী’ শব্দের উৎপত্তি হয়ে; কিন্তু যেহেতু এরা ছিলো বেশ্যা, তাই নটী শব্দটি বেশ্যার সমর্থক শব্দ হিসেবে পরিচিতি পায় এবং সে কারণেই কোনো মেয়েকে বেশ্যা হিসেবে গালি দিতে গিয়ে গ্রাম বাংলায় নটী শব্দটির প্রয়োগ শুরু হয়।
আমি মিডিয়া সম্পর্কে যতটুকু জানি, সেই জানা থেকে বলছি, আগে যেমন বেশ্যা না হলে কোনো মেয়ে নাটক থিয়েটারে অভিনয় করতো না; এখনও তেমনি কোনো মেয়ে, প্রযোজক-পরিচালকের কাছে নিজেকে বেশ্যা প্রমান না করা পর্যন্ত নাটক সিনেমায় অভিনয়ের কোনো সুযোগ পায় না। সুতরাং যেসব মেয়ে নাটক সিনেমায় অভিনয় করতে চান, তারা এই বিষয়টি মাথায় রাখবেন; কারণ, পরিচালক-প্রযোজক যদি আপনার নিজের পরিবারের বা আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে কেউ না হয়, আপনি নিজের কাপড়-চোপড়, পরিচালক প্রযোজকদের কাছে না খুলে কখনোই পর্দায় মুখ দেখাতে পারবেন না।
সুতরাং ৩৭ নং উপপাপ থেকে এটা নিশ্চিত যে, হিন্দু শাস্ত্রে বেশ্যাবৃত্তি বা দেহ ব্যবসা নিষিদ্ধ। কিন্তু অনেক মুসলমান জোর দিয়ে একথা বলে যে, ইসলামে ব্যাভিচার নিষিদ্ধ, এর মাধ্যমে ইসলামে বেশ্যাবৃত্তি বা দেহ ব্যবসাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু নিচের এই আয়াত কী বলছে দেখুন-
“আর তোমাদের দাসীদের নিজেদের বৈষয়িকস্বার্থের জন্য বেশ্যাবৃত্তি করতে বাধ্য করো না, যখন তারা নিজেরা চরিত্রবতী থাকতে চায়। যে তাদেরকে সেজন্য জবরদস্তি করবে, আল্লা এ জবরদস্তির পরতাদের জন্য ক্ষমাশীল, দয়াময়।”- (কোরান, ২৪/৩৩)
এখানে আল্লার চরিত্রটা বোঝার একটু চেষ্টা করুন, প্রথমে সে বললো, দাসীদের বেশ্যাবৃত্তি করতে বাধ্য করো না। খুব ভালো কথা, এমন হলে অন্তত কোরানের একটি নির্দেশকে মানবিক বলে মেনে নিয়ে তার প্রশংসা করা যেতো। কিন্তু পরক্ষণেই আল্লা বললো, যে তাদেরকে সেজন্য অর্থাৎ বেশ্যাবৃত্তির জন্য জবরদস্তি করবে, আল্লা এ জবরদস্তির পরও তাদের জন্য ক্ষমাশীল, দয়াময়। তাহলে প্রথমে আল্লা যে বললো, দাসীদেরকে বেশ্যাবৃত্তি করতে বাধ্য করো না, আল্লার সেই কথাটার মানেটা কী ?
স্পষ্টত এই আয়াতের মাধ্যমে ইসলামে বেশ্যাবৃত্তিকে হালাল করা হয়েছে। এছাড়াও ইসলামের বিয়ে বেশ্যাবৃত্তির একটা চুক্তি। কারণ, দেনমোহরের নামে মেয়ের দেহের দাম পরিশোধ না করলে কোনো মুসলিম ছেলে বাসর রাতে তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে স্পর্শও করতে পারে না, যেটা পতিতালয়ের একটা অলিখিত নিয়ম, অর্থাৎ পতিতালয়ের নিয়ম হচ্ছে আগে পেমেন্ট, পরে কাজ বা শোয়া, যেটা মুসলমানদের বিয়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এজন্যই আমি মুসলিম বিয়েকে বেশ্যাবৃত্তির একটা চুক্তি মনে করি এবং সকল মুসলিম মেয়েকে গৃহপালিত পতিতা মনে করি। কারণ, মুসলমান বরেরা নামে মাত্র দেনমোহর দিয়ে বা স্ত্রীর কাছে থেকে দেনমোহরের টাকা মাফ চেয়ে নিয়ে স্ত্রীর সাথে এক বিছানায় শোয়ার অনুমতি আদায় করে নিলেও, পরে কোনো কারণে যখন তালাক হয়ে যায়, সেই দেনমোহর, যা বিয়ের চুক্তি কাবিন নামায় উল্লেখ থাকে, মুসলিম মেয়েরা তা সুদে আসলে আদায় করে নেয়, ব্যাপারটা এমন- এতদিন দেহভোগ করে মজা লুটেছিস, এখন তার দাম দিবি না ? এই সব তথ্য জানার পর কারো পক্ষে কিভাবে, ‘মুসলিম বিয়ে বেশ্যাবৃত্তির চুক্তি নয়’ এটা বলা সম্ভব ?
কিন্তু কোনো হিন্দু মেয়ে এইরকম গৃহপালিত পতিতা নয়; কারণ, হিন্দু বিয়ে কোনো চুক্তি নয় এবং হিন্দু রীতিতে বিয়ের পর বর ও কনের মধ্যে যে শারীরিক মিলন হয় সেখানে অর্থের লেন-দেনের কোনো ব্যাপার থাকে না। এইসব কারণে হিন্দু বিয়ে একটি ব্রত বা ধর্মানুষ্ঠান এবং সেই জন্যই হিন্দু ছেলে মেয়েকে অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানে উপবাস রাখার মতো করে বিয়ের দিনও সাতপাক না ঘোরা পর্যন্ত উপবাস থাকতে হয়। হিন্দু বিবাহ একটি ধর্মানুষ্ঠান বলেই বর ও কনে কে এই নিয়ম পালন করতে হয়।
যা হোক, এই পতিতাবৃত্তি বা বেশ্যাবৃত্তি নারীর জন্য অবমাননাকর এবং সমাজ দূষণের কারণ ব’লে, সেই ৮/১০ হাজার বছর আগেই হিন্দুশাস্ত্রে এটাকে পাপ বলে উল্লেখ করে একে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সেকারণেই সিন্ধু সভ্যতার সময় থেকে শুরু করে ভারতে মুসলমান শাসন শুরুর পূর্ব পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশে বেশ্যাবৃত্তি বা দেহ ব্যবসার কোনো ইতিহাস বা নজির নেই। মুসলমান শাসনের সময়ও ভারতে কোনো পতিতালয় প্রতিষ্ঠিত হয় নি; কারণ, দাসী ভোগের অধিকার দিয়ে প্রতিটি মুসলমানের বাড়িকেই তো মুহম্মদ এক একটি মিনি পতিতালয় বানানোর বিধান ও সুযোগ করে দিয়েছিলো, তাই পৃথিবীর সবচেয়ে কামুক জাতি কোনো মুসলমানকে বাড়ির বাইরে যৌন ক্ষুধা মেটানোর জন্য যাবার প্রয়োজনই পড়তো না; ভারতের মুসলমান শাসকরা তাদের হেরেমেও রাখতো হাজার হাজার হিন্দু যৌনদাসী। তাই কোনো দিক থেকেই ভারতে মুসলমান শাসনামলে কোনো পতিতালয় স্থাপিত হয় নি বা গড়ে উঠার সুযোগ পায় নি।
কিন্তু ইংরেজরা ভারতে এসে মুসলমানদের কবলে থাকা সেই সব যৌনদাসীদের মুক্ত করে দিলেও, সমাজে তাদের কোনো সম্মান না থাকায় এবং ভারতে থাকা হাজার হাজার ইউরোপিয়ানদের যৌন চাহিদা পূরণে আবার কিছু মেয়ে স্বেচ্ছায় তাদের দেহ বিক্রি করতে শুরু করে, এতে সেই মেয়েগুলোও বেঁচে থাকার অবলম্বন পায় এবং ইউরোপিয়ানদেরও সাময়িক অসুবিধা দূর হয়; তাই এই সব মেয়েদের জন্য ইংরেজরা তাদের সুবিধামতো জায়গায় একটি করে বাসস্থান নির্ধারণ করে দেয়, যা পরে পতিতাপল্লি হিসেবে পরিচিত পায়। খোঁজ নিয়ে দেখবেন, ভারতীয় উপমহাদেশের যত জায়গায় পতিতাপল্লী ছিলো বা আছে, সব ইংরেজ আমলে, ইংরেজদের ছত্রছায়ায় ও ইংরেজদের প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
যা হোক, এরপর ৩৮ ও ৩৯ নং উপপাপে বলা হয়েছে, ধান্যচুরি ও পশুচুরি।
বিষয়টা এত সাধারণ যে, এটা নিয়ে কিছু বলার আছে বলে মনে করছি না।
এরপর ৪০ নং উপপাপে বলা হয়েছে, ‘কূপ্য’, এর অর্থ সোনা ও রূপা ছাড়া যে কোনো প্রকারের ধাতব পদার্থ চুরি, এটা নিয়েও কিছু বলার প্রয়োজন নেই, কিন্তু ‘কূপ্য’ এর অর্থ যেহেতু সোনা ও রূপা ছাড়া অন্য ধাতব পদার্থ, সেহেতু মনে হতে পারে যে, সোনা ও রূপা চুরি করলে বোধ হয় কোনো পাপ নেই, কিন্তু ব্যাপারটা সেরকম নয়, সোনা ও রূপা ছাড়া অন্য পদার্থ চুরি উপপাপ, কিন্তু সোনা ও রূপা চুরি করা মহাপাপ, এই আলোচনা পাবেন একটু পরেই ।
এরপর ৪১ নং উপপাপে বলা হয়েছে, ‘মদ্যপস্ত্রীনিসেবন’ অর্থাৎ যে নারী মদ্য পান করে তাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহন।
এটা নিয়েও বেশি কিছু বলার নেই, কারণ- যে স্ত্রী মদ্য পান করবে, তার চরিত্র খারাপ হবেই, অর্থাৎ সে নানা পুরুষের সাথে মিশবে। এ ধরণের স্ত্রীকে নিয়ে কেউ সুখী হতে পারে না বা সংসার করতে পারবে না, তাই এ ধরণের নারীকে বিয়ে করতে হিন্দু শাস্ত্রে নিষেধ করা হয়েছে। এ থেকেও প্রমাণিত হয় যে, হিন্দু সমাজে মদের ব্যবহার একেবারে নিষিদ্ধ।
এরপর ৪২, ৪৩, ৪৪ এবং ৪৫ নং উপপাপে বলা হয়েছে- স্ত্রীবধ, শুদ্রবধ, বৈশ্যবধ, ক্ষত্রিয়বধ, অর্থাৎ সকল প্রকার নরহত্যা নিষেধ।
মানবতার বিচারে এটা যে পাপ, সেটা নিয়ে তো আর নতুন করে কিছু বলার প্রয়োজন নেই। কিন্তু ইসলামের বিচারে মানুষ হত্যা কোনো পাপ নয়, বরং ইসলাম অস্বীকারকারীদেরকে কাফের আখ্যা দিয়ে তাদেরকে হত্যা করতে কোরানের বহু জায়গায় নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং মুহম্মদের জীবনীতেও তার বহু উদাহরণ রয়েছে। যার আলোচনা এই সিরিজের তৃতীয় পর্বের ৩১ নং উপপাপে উল্লেখ করেছি নিচের এই কয়েকটি আয়াতের মাধ্যমে, দেখে নিন সেই আয়াতগুলো আরো একবার-
“ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম চাইলে কখনো তা গ্রহণ করা হবে না।”-(কোরান, ৩/৮৫)
“মুশরিকদের(মূর্তিপূজারী) হত্যা কর যেখানেই তাদের পাও এবং তাদের ধরো, ঘেরাও করো এবং তাদের প্রতিটি ঘাঁটিতে তাদের খবরাখবর নেওয়ার জন্য শক্ত হয়ে বসো। অতঃপর তারা যদি তওবা করে, নামায কায়েম করে ও যাকাত দেয় (অর্থাৎ মুসলমান হয়), তাহলে তাদেরকে তাদের পথ ছেড়ে দাও। আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল ও করুনাময়।” (কোরান, ৯/৫)
“কিন্তু বাঁচতে পারবে শুধু তারাই, যারা তওবা করবে (অর্থাৎ মুসলমান হবে), তাদের উপর তোমাদের(অর্থাৎ মুসলমানদের) আধিপত্য স্থাপিত হওয়ার পূর্বে।”- (কোরান, ৫/৩৪)
“নামায কায়েম কর, যাকাত দাও এবং রসূলের আনুগত্য কর (মানে মুসলমান হও)। আশা আছে যে তোমাদের প্রতি রহম করা হবে।”- (কোরান, ২৪/৫৬)
যা হোক, উপরে এতক্ষণ আলোচনা করলাম হিন্দু শাস্ত্রে বর্ণিত উপপাপ সম্পর্কে, এবার আলোচনা করছি মহাপাপ সম্পর্কে। হিন্দু শাস্ত্রে চার ধরণের পাপকে মহাপাপ বলা হয়েছে, এর প্রথমটা হলো ব্রহ্মহত্যা, মানে ব্রাহ্মণকে হত্যা।
একটু আগেই বলেছি- স্ত্রী, শুদ্র, বৈশ্য ও ক্ষত্রিয় বধ সম্পর্কে, এগুলোকে হিন্দু শাস্ত্রে উপপাপ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে, কিন্তু ব্রাহ্মণ হত্যাকে মহাপাপ বলা হচ্ছে কেনো ?
ব্রাহ্মণ হত্যাকে মহাপাপ কেনো বলা হয়েছে, সেই আলোচনায় যাওয়ার পূর্বে, অন্য নরহত্যাগুলোকে মহাপাপ হিসেবে আখ্যায়িত না ক’রে, উপপাপ হিসেবে কেনো আখ্যায়িত করা হয়েছে, এই প্রশ্ন অনেকের মাথায় আসতে পারে, সেজন্য এটার ব্যাখ্যাটা আগে দিই।
গুনের বিচারে ব্রাহ্মণরা হলো মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ জাতি, এই শ্রেষ্ঠত্ব যারা অর্জন করবে, তারা কখনো কোনো অবস্থাতেই কোনো মানুষ বা সমাজের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে না বা হবে না, তাই ব্রাহ্মণ হত্যাকে মহাপাপ বলা হয়েছে। কিন্তু যখন কোনো মানুষ, নিজের ও সমাজের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে, তখন তাদেরকে হত্যা করা মোটেই পাপ নয়, এজন্যই হিন্দু শাস্ত্রে ছয় ধরণের মানুষকে আততায়ী বলা হয়েছে এবং তাদেরকে হত্যার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, এরা হলো-
১. অগ্নি দাতা, ২. বিষ দাতা, ৩. ধারালোঅস্ত্র হাতে আক্রমনকারী, ৪. ধনসম্পদ লুণ্ঠনকারী, ৫. জমি-জায়গা দখলকারী এবং ৬. ঘরের মেয়েদের অপহরণকারী।
দেখে নিন উপরের এই নির্দেশ সম্বলিত বশিষ্ঠ সংহিতা (৩/১৬) সেই শ্লোকটি-
“অগ্নিদোগরদোশ্চৈবশস্ত্রপাণীর্ধনাপহঃ
ক্ষেত্রদারাপহারী চ ষড়েতেহ্যাতায়িনঃ"
এই ছয় ধরণের ব্যক্তিকে যে কোনোরকম দ্বিধা না করে হত্যা করতে হবে, সেই নির্দেশ দেওয়া আছে মনুসংহিতার এই শ্লোকে-
“গুরুং বা বালবৃদ্ধৌ বা ব্রাহ্মণং বা বহুশ্রুতম্
আততায়ীনমায়ান্তং হন্যাদেবাহবিচারয়ম।”- (মনুসংহিতা, ৮/৩৫০)
এর অর্থ, আততায়ী যদি গুরু হয়, বালক হয় বা বৃদ্ধ হয়, ব্রাহ্মণ হয় বা বহু লেখাপড়া জানা বিদ্বান ব্যক্তিও হয়, তবে সেই অগ্রসরমান আততায়ী ব্যক্তিকে কোনো বিচার বিবেচনা না করে তৎক্ষণাৎ হত্যা করতে হবে।
এখানে আততায়ী হলে ব্রাহ্মণকেও হত্যা করতে বলা হয়েছে, এর মানে হলো প্রচলিত অর্থে বা পরিচিত সূত্রে কোনো ব্যক্তি ব্রাহ্মণ হলেও, যখন সে কারো ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে, তখন তার মধ্যে আর ব্রাহ্মণত্ব থাকবে না, তখন সে শুধুই অপরাধী, তাই তাকে হত্যা করতে বলা হয়েছে।
নিজেকে এবং নিজের পরিবার ও সম্পদ রক্ষার্থে যেকোনো ব্যক্তিকে হত্যার নির্দেশ শাস্ত্র দিলেও এবং এর জন্য পরকালে কোনো শাস্তি না হলেও, যেহেতু সমাজ বা রাষ্ট্রে যেকোনো প্রকার নরহত্যাকেই অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়, তাই ব্রাহ্মণ হত্যা ছাড়া অন্য নরহত্যাগুলোকে হিন্দু শাস্ত্রে উপপাপ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এখানে আরেকটি বিষয় মনে রাখবেন, কোনো না কোনোভাবে উপপাপগুলো থেকে মুক্তি পাওয়া যায় বা যেতে পারে, কিন্তু মহাপাপ থেকে মুক্তি কেউ কখনোই পায় না বা পাবে না।
যা হোক, এবার ব্রাহ্মণ হত্যা কেনো মহাপাপ সেই ব্যাখ্যা দিই।
জন্মসূত্রে নয়, কর্মসূত্রে যে ব্যক্তি সমাজের সকল স্তরের মানুষকে জ্ঞান প্রদানের কাজ করেন, তিনিই ব্রাহ্মণ শ্রেণিতে উত্তীর্ণ বা ব্রাহ্মণ বলে বিবেচ্য। জ্ঞান হচ্ছে সমাজ নির্মান ও পরিচালনার প্রধান ভিত্তি, তাই কোনো জ্ঞানী ব্যক্তিকে হত্যা করা মানে সেই সমাজের ভিত্তিকেই ধ্বংস করে দেওয়া এবং এটা এক ধরণের অপূরণীয় ক্ষতি; এই ক্ষতি থেকে সমাজকে রক্ষা করতেই ব্রহ্মহত্যার নাম করে সকল প্রকার জ্ঞানীকে হত্যা করতে চরমভাবে নিষেধ করে একে মহাপাপ বলে গণ্য করা হয়েছে, মূলত সমাজে যাতে জ্ঞানী ব্যাক্তিরা বেঁচে থেকে সমাজ সেবায় তাদের জ্ঞানকে কাজে লাগাতে পারে, সেজন্য।
ইসলামের ইতিহাসেও এরকম একটি উদাহরণ আছে।
বদরের যুদ্ধের পর মুহম্মদ, কয়েকজন কোরাইশকে জীবিত বন্দী করে তাদের আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে মুক্তিপণ নিয়ে তাদেরকে ছাড়বে ব’লে, যাতে ডাকাতির বিজনেস থেকে মুসলমানরা আরো লাভবান হয়; কারণ, জিহাদের নামে অমুসলিমদের বন্দী করে এই মুক্তিপণ আদায় করে খাওয়া ছিলো মুহম্মদের কৌশলগুলোর অন্যতম, যার মাধ্যমে মুহম্মদ মুসলমানদের দারিদ্র দূর করার স্বপ্ন দেখতো এবং সে তার সাহাবীদের বলেছিলোও যে, আমি তোমাদের দারিদ্রতা নিয়ে ভীত নই।
এখন আপনিই চিন্তা করুন, কোন ধরণের ব্যক্তিরা মুক্তিপণের বিজনেস করে ? যদি কারো সাথে আমার আদর্শের বিরোধ হয় এবং তাদের সাথে যুদ্ধ হয়, তাহলে তাদেরকে জীবিত ছাড়বো কেনো ? আর তাদেরকে জীবিত রেখে তাদের আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে মুক্তিপণই বা নেবো কেনো ? যদি আমি এটা করি, তাহলে আমি কোনো ধর্মপ্রচারক, না ডাকাত সর্দার ?
যা হোক, কয়েক জন বন্দীকে কোরাইশরা উচ্চমূল্যের মুক্তিপণ দিয়ে মুহম্মদের নিকট থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়, কিন্তু একজনকে ছাড়ানোর মতো টাকা তার আত্মীয়দের কাছে ছিলো না, কিন্তু সেই বন্দী কিছু পড়াশোনা জানতো, তাই মুহম্মদ শর্ত দেয়, সে মদীনায় বাস করে মুসলমানদেরকে পড়াশোনা শেখাবে, এটাই হবে তার মুক্তিপণ। এভাবে সে কয়েকজন মুসলমানকে পড়াশোনা শিখিয়ে নিজেকে বন্দী দশা থেকে মুক্ত করে। মুসলমানরা শিক্ষক হিসেবে হিন্দু বা অমুসলিমদেরকে যে কিছুটা এ্যাকসেপ্ট করে বা বাসায় টিউটর হিসেবে নিয়োগ করে, সেটা মুহম্মদের এই হাদিসের জন্য। কারণ, এই ঘটনাকে স্মরণ করে মুসলমানরা মনে করে অমুসলিমদের নিকট থেকে শিক্ষা লাভ করা জায়েজ আছে। যদিও বাংলার ৯৮% মুসলমান জানে না যে, অমুসলিমদের সাথে মুসলমানদের উঠা-বসা, ব্যবসায়িক লেনদেন করা, এক সাথে খাওয়া ও বন্ধুত্ব করা হারাম। ইসলামের ইতিহাসের ওই ঘটনা না থাকলে বাংলাদেশে হিন্দুরা শিক্ষা ক্ষেত্রে বা টিউটর হিসেবে কখনো সুযোগ লাভ করতে পারতো না।
যা হোক, মহাপাপের দ্বিতীয়টা হলো- সুরাপান বা মদ্যপান।
হিন্দু শাস্ত্র সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার ফলে, অনেকেই মনে করে হিন্দু ধর্মে বুঝি মদ্যপান বৈধ। এই সুযোগ নেয় মুসলমানরা এবং তারা খুব গর্বের সাথে প্রচার করে যে, মদ পানের কুফল বুঝতে পেরে ইসলামে সেই ১৪০০ বছর আগেই মদপান নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু হিন্দু শাস্ত্রে মদপানকে মহাপাপ হিসেবে গণ্য করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে সেই সভ্যতার শুরুতেই অর্থাৎ ৮/১০ হাজার বছর আগে। এই তথ্য থেকে আবারও প্রমান হলো যে, হিন্দুধর্ম ইসলামের বাপের বাপের বাপের বাপের বাপের বাপ।
মহাপাপের তৃতীয়টা হলো- চুরি, বিশেষ করে সোনা ও রূপার মতো মূল্যবান ধাতু চুরি। কারণ, এগুলো মূল্যবান বলে অল্প পরিমান চুরি করেই মানুষের প্রভূত ক্ষতি করা সম্ভব এবং এগুলো চুরি করাও অন্য যেকনো বস্তুর চেয়ে সহজ। সেজন্য অন্য যেকোনো বস্তুকে চুরি করা উপপাপ হিসেবে গণ্য করা হলেও, সোনার মতো ধাতু চুরিকে মহাপাপ বলা হয়েছে।
মহাপাপের চতুর্থটা হলো- গুরুপত্নীতে গমন।
এর সহজ মানে হলো গুরু অর্থাৎ যে আপনাকে জীবন পথে চলার জন্য জ্ঞান প্রদান করেন, তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা। এটাকে মহাপাপ হিসেবে গণ্য করার কারণ হলো, কেউ যদি গুরুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে, তাহলে সে কোথাও জ্ঞান লাভ করতে পারবে না, আর এমন হলে তার মানবজীবনটাই ব্যর্থ হবে। তাই গুরুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতাকে হিন্দু শাস্ত্রে মহাপাপ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
হিন্দু শাস্ত্রে বর্ণিত মহাপাপ এবং উপপাপের মোট সংখ্যা ৪৯টি। মানব জীবনাচরণে এই ৪৯ প্রকার বিধিনিষেধ, সভ্যতার সূচনালগ্নেই, হিন্দু শাস্ত্র মানুষকে প্রদান ক’রে, একটি মানব শিশুকে আদর্শ মানু্ষ হিসেবে গড়ে উঠার ও নিজের জীবনকে পরিচালিত করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে; যার কারণে হিন্দুরা জন্মগতভাবেই আদর্শ মানুষ এবং যারা বিভিন্ন ব্যক্তিমতের ধর্মে বিশ্বাস করেও মানুষের মতো জীবনযাপন করে, তারাও প্রকারন্তরে হিন্দুধর্মই পালন করে এবং হিন্দুদের মতো আদর্শ মানুষ হওয়ার চেষ্টা করে।
হিন্দুশাস্ত্রে বর্ণিত পাপ মহাপাপের এই দীর্ঘ আলোচনায় আমার সাথে থাকার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
জয় হোক সনাতনের
Source of: Online
No comments:
Post a Comment
Thank you for your message, I see all your messages, it is not possible to reply many times due to busyness, I hope I will reply to everyone in time, thank you for being with me. Thanks you watching my content. Please like, Follow, Subscribe.