b Sanatan Dharma - সনাতন ধর্ম

https://a-ads.com/

ব্রেকিং নিউজ

সর্বশেষ সংবাদ সবার আগে বিস্তারিত জানতে চোখ রাখুন । আপনার প্রতিষ্ঠানের প্রচারের জন্য বিজ্ঞাপন দিন। বিজ্ঞপ্তি: জরুরী সংবাদকর্মী নিয়োগ চলিতেছে…। আপনি কি কম খরচে Website, Bloggersite, Youtube channel, E-commica site তৈরি করতে চান? যোগাযোগ করুন বিস্তারিত : মোবাইল: 01712475454,01940103713 , দেশ - বিদেশের খবর সবার আগে জানতে সাথে থাকুন।আমাদের সংঙ্গে থাকার জন্য ধন্যবাদ এ রকম আরও ভিডিও/ সর্বশেষ সংবাদ Update News পেতে আমাদের Website /Youtube Channel পেইজে লাইক দিন৷ ❤️ ✌ ✔️ কোন মতামত বা প্রশ্ন থাকলে কমোন্ট করে জানান।

Tuesday, April 2, 2024

প্রয়োজনীয় ত্রিশটি মন্ত্র মুখস্ত রাখতে পারলে ভালো,। হিন্দুদের সকল প্রয়োজনীয়-মন্ত্র ,All essential mantras of Hindus

প্রয়োজনীয় ত্রিশটি মন্ত্র মুখস্ত রাখতে পারলে ভালো,। হিন্দুদের সকল প্রয়োজনীয়-মন্ত্র ,All essential mantras of Hindus

৩০টি মন্ত্রের নামের তালিকা -
১৷গুরু প্রণাম মন্ত্র
"ওঁ অজ্ঞান তিমিরান্ধস্য জ্ঞানাঞ্জন শলাকয়া।
চক্ষুরুন্মিলিত যেন তস্মৈ শ্রী গুরুবে নমঃ ।।
২৷শ্রীকৃষ্ণের প্রণাম মন্ত্র
"হে কৃষ্ণ করুণা সিন্ধু দীনবন্ধু জগৎপথে।
গোপেশ গোপীকা কান্ত রাধা কান্ত নমহস্তুতে ।।"
৩৷ শ্রী রাধারানী প্রণাম মন্ত্র
"তপ্ত কাঞ্চন গৌরাঙ্গীং রাধে বৃন্দাবনেশ্বরী।
বৃষভানু সূতে দেবী তাং প্রণমামি হরি প্রিয়ে।।"
৪৷ শ্রী পঞ্চতত্ত্ব প্রনাম মন্ত্র
""পঞ্চতত্ত্ব আত্মকং কৃষ্ণং ভক্তরূপ স্বরূপকম্ ।
ভক্ত অবতারং ভক্তাখ্যাং নমামি ভক্ত শক্তিকম্ ৷৷""
৫৷ পঞ্চতত্ত্ব মহামন্ত্র
" জয় শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্যপ্রভু নিত্যানন্দ শ্রী অদৈত্ব গদাধর শ্রীবাসাদি গৌর ভক্ত বৃন্দ""
৬৷ হরিনাম মহামন্ত্র
"" হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে // হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে ৷৷""
৭৷ শ্রী পিতার প্রনাম মন্ত্র
"পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম, পিতাহি পরমং তপ।
পিতোরি প্রিতিমা পন্নে প্রিয়ন্তে সর্ব দেবতাঃ।। ""
৮৷ শ্রীমাতার প্রনাম মন্ত্র
"মাতা জননী ধরিত্রী, দয়াদ্র হৃদয়া সতী।
দেবীভ্যো রমণী শ্রেষ্ঠা নির্দ্দোশা সর্ব দুঃখ হারা।।"
৯৷ শ্রী বৈষ্ণব প্রণাম মন্ত্র
""বাঞ্ছাকল্প তরুভ্যশ্চ কৃপাসিন্ধুভ্য এব চ।
পতিতানাং পাবনেভ্যা বৈষ্ণবেভ্যে নমো নমঃ ।।""
১০৷ মহাপ্রভু গৌরাঙ্গের প্রণাম মন্ত্র
"নমো মহাবদান্যায় কৃষ্ণপ্রেম প্রদায় তে।
কৃষ্ণায় কৃষ্ণচৈতন্যানাম্নে গৌরত্বিষে নমঃ৷"
১১৷ তুলসী প্রণাম মন্ত্র
""বৃন্দায়ৈ তুলসী দৈব্যে প্রিয়ায়ৈ কেশবস্য চ ।
কৃষ্ণ ভক্তি প্রদে দেবী সত্যবত্যৈঃ নমঃ নমঃ ।।""
১২৷ তুলসী জলদান মন্ত্র
""গোবিন্দ বল্লভাং দেবী ভক্ত চৈতন্য কারিনী।
স্নাপযামি জগদ্ধাত্রীং কৃষ্ণভক্তি প্রদায়িনী।।""
১৩৷ তুলসী পত্র চয়ন মন্ত্র
""ওঁ তুলস্যমৃতজন্মাসি সদা ত্বং কেশবপ্রিয়া।
কেশবার্থে চিনোমি ত্বাং বরদা ভব শোভনে॥""
১৪৷ তুলসীদেবীর কাছে ক্ষমা প্রর্থনা মন্ত্র
""চয়নোদ্ভবদুঃখং চ যদ্ হৃদি তব বর্ততে।
তত্ ক্ষমস্ব জগন্মাতঃ বৃন্দাদেবী নমোহস্ততে॥""
১৫৷ গোবিন্দ প্রনাম মন্ত্র
""ওম ব্রহ্মাণ্ড দেবায় গোব্রাহ্মণ হিতায় চঃ জগদ্ধিতায় শ্রীকৃষ্ণায় গোবিন্দায় নমঃ॥""
১৬৷ আচমন মন্ত্র
""ওঁ বিষ্ণু ওঁ বিষ্ণু ওঁ বিষ্ণু।
ওঁ তদ্বিষ্ণু পরমং পদং সদাপশ্যান্তি সুরয়। দিবিব চহ্মুরাততম।""
১৭৷গঙ্গা প্রনাম মন্ত্র
"'"ওঁ সদ্যঃপাতকসংহন্ত্র

Tuesday, March 26, 2024

ঋগ্বেদ সংহিতা(ভূমিকা-দ্বতীয় পরিচ্ছেদ।)

 

ঋগ্বেদ সংহিতা(ভূমিকা-দ্বতীয় পরিচ্ছেদ।)

ওঁ

ঋগ্বেদ সংহিতা

ভূমিকা- দ্বতীয় পরিচ্ছেদ।

বেদ বিষয়ে দর্শন-শাস্ত্র।

[বেদ বিষয়ক বিতর্ক দর্শন শাস্ত্রে; -শব্দের নিত্যত্ব বিষয়ে নৈয়ায়িকদের আপত্তি;- মীমাংসক কর্ত্তৃক সেই আপত্তির খণ্ডন;- মীমাংসাদর্শনে বেদের নিত্যত্ব বিষয়ে যুক্তি; -বেদের প্রামাণ্য-বিষয়ে গৌতমের পূর্বপক্ষ রূপে বিতর্ক ও উত্তরপক্ষ রূপে উত্তর; -বেদের প্রামাণ্য বিষয়ে পূর্বপক্ষ রূপে অপরাপর বিতর্ক এবং উত্তরপক্ষ রূপে তার উত্তর; বেদের অপৌরুষত্ব সম্বন্ধে বিতর্ক ও মীমাংসা;- বেদ বিষয়ে সাংখ্য, বৈশেষিক ও বেদান্ত আদির মত।]

বেদ বিষয়ক বিতর্ক

সকল শাস্ত্রেই বেদ বিষয়ে আলোচনা দেখা যায়। বেদ যে নিত্য, বেদ যে অপৌরুষেয়, বেদ যে অনাদি, এ সম্বন্ধে বিচার-বিতর্কের অবধি নেই। ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, উপনিষৎ, দর্শন, পুরাণ-সর্বত্রই বেদ-বিষয়ক আলোচনা আছে। সে সম্বন্ধে দর্শন-শাস্ত্রের বিচার ও মীমাংসা, জ্ঞানার্থি মাত্রই কৌতুহল উদ্দীপক। সুতরাং অন্যান্য শাস্ত্রে বেদের বিষয় কিভাবে আলোচিত হয়েছে, তা উল্লেখের পূর্বে, বেদ বিষয়ে দর্শন শাস্ত্রের গবেষণার আভাষ তুলে ধরা গেল। বিচারে পূর্বপক্ষ ও উত্তরপক্ষ রূপে বেদ প্রতিবাদ দ্বারা মীমাংসা হয়ে থাকে। এক সম্প্রদায়ের দার্শনিকেরা বেদের অপৌরুষেয়ত্ব বা নিত্যত্ব স্বীকার করেন না; এবং সেই পক্ষেই যুক্তিজাল বিস্তার করে থাকেন। অপর সম্প্রদায়ের দার্শনিকেরা প্রথমোক্ত সপ্রদায়ের যুক্তি-পরম্পরাকে পূর্বপক্ষরূপে পরিগ্রহণ করে, উত্তরপক্ষ রূপে তার উত্তর দিয়ে গেছেন। এ সম্বন্ধে নৈয়ায়িকদের ও মীমাংসকদের বিচার-প্রণালী বিশেষভাবে প্রণিধানের বিষয়।

১। বেদ নিত্য কি না-তার বিষয়ে বিতর্ক ও মীমাংসা। শব্দের নিত্যত্ব বিষয়ে আপত্তি।

নৈয়ায়িকরা বলেন, ‘শব্দ কখনও নিত্য হতে পারে না। বেদ যখন শব্দসমষ্টি, তখন এর নিত্যত্বে বিঘ্ন ঘটছে। এই সম্বন্ধে নৈয়ায়িকদের ছয়টি প্রসিদ্ধ সূত্র দেখতে পাওয়া যায়। প্রথম,-“কর্ম্ম একে তত্র দর্শনাৎ।” অর্থাৎ, যত্নদ্বারা শব্দ উচ্চারিত হয়। যা চেষ্টা সাপেক্ষ, তাই কর্ম। কর্ম ধ্বংসশীল, সুতরাং শব্দও অনিত্য। দ্বিতীয়, “অস্থানাৎ” অর্থাৎ, উৎপত্তি মাত্র শব্দ নষ্ট হয়; শব্দ অস্থায়ী; সুতরাং শব্দে নিত্যত্ব সম্ভব নয়। তৃতীয়,- “করোতি শব্দাৎ” অর্থাৎ, শব্দ করে থাকে অর্থাৎ লোকে শব্দের সৃষ্টিকর্ত্তা। যা করা হয়(লোকে তৈরি করে), তা কখনই নিত্য হতে পারে না। চতুর্থ,- “সত্ত্বান্তরে যৌগপদ্যাৎ” অর্থাৎ, শব্দ একই সময় নিকটস্থ এবং দূরস্থ বহু ব্যক্তি শুনতে পায়। সুতরাং শব্দ এক ও নিত্য হতে পারে না। পঞ্চম,- “প্রকৃতিবিকৃত্যোশ্চ” অর্থাৎ, প্রকৃতি প্রত্যয় হেতু শব্দ রূপান্তরিত হয়ে থাকে; যার রূপান্তর বা বিকৃতি ঘটে, তাকে কখনই নিত্য বলা যেতে পারে না। ষষ্ঠ,- “বৃদ্ধিশ্চ কর্ত্তৃভূম্নাস্য” অর্থাৎ, একই শব্দ একাধিক ব্যক্তি উচ্চারণ করলে, একাধিক বার সেই শব্দ উচ্চারিত হতে পারে। শব্দকর্ত্তার সংখ্যার হ্রাস-বৃদ্ধি হেতু শব্দেরও হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে থাকে। যা হ্রাসবৃদ্ধিশীল, তা নিত্য হতে পারে না। এরূপে নৈয়ায়িকেরা বেদের নিত্যত্ব-বিষয়ে প্রতিবাদ উত্থাপন করে থাকেন।

পূর্ব্বোক্ত আপত্তির খণ্ডন-

মীমাংসকগণ ঐরূপ আপত্তির খণ্ডন করে গেছেন। পূর্বপক্ষরূপে ঐ সকল আপত্তি উত্থাপন করে, মীমাংসা দর্শনের নিন্মলিখিত সূত্র পঞ্চকে তাদের নিরসন করা হয়েছে।

প্রথমে,- “স্বতঃ পরমদর্শনং বিষয়ানাগমাৎ” অর্থাৎ, শব্দ উচ্চারিত হলেও শব্দকারীর সাথে এর সম্বন্ধ থাকে না। পরন্তু যে শব্দে যে জ্ঞান, তা সমভাবেই বিদ্যমান থাকে। সুতরাং শব্দ অনিত্য নয়, নিত্য। ‘রাম’ এই শব্দ শ্রুতিগোচর হলে, ঐ শব্দের একটি জ্ঞান থেকে যায়; পূর্বে ঐ শব্দ যেমন শুনেছি, তার সাথে এর অভিন্নতা সূচিত হয়। সুতরাং, শব্দের নিত্য ও একত্ব অনুভবসিদ্ধ। দ্বিতীয়,-“প্রয়োগস্য পরমং” অর্থাৎ ‘শব্দ করে’ এর তাৎপর্য্য- শব্দের নির্মাণ নয়, শব্দের উচ্চারণ মাত্র। তৃতীয়,-“আদিত্যবৎ যৌগপদ্যং” অর্থাৎ সূর্য্য যেমন নিকটস্থ ও দূরস্থ সকল ব্যক্তির পরিদৃশ্যমান, অথচ তিনি যেমন এক ভিন্ন দ্বিতীয় নহেন, শব্দও সেরূপ বহু ব্যক্তির কর্ণে ধ্বনিত হলেও এক ভিন্ন দ্বিতীয় হয় না। চতুর্থ,- “বর্ণান্তরমবিকারঃ” অর্থাৎ প্রকৃতি প্রত্যয় সহযোগে বর্ণের পরিবর্ত্তনে বর্ণের বিকার হয় না; বর্ণান্তরে বর্ণের অবস্থিতি ঘটে মাত্র। যেমন, ‘ই’ কার স্থানে ‘য’ কার হলে, বর্ণান্তর আদেশ হয় বটে; কিন্তু ‘ই’ কারের কোনও অসদ্ভাব ঘটে না। পঞ্চম,- “নাদবৃদ্ধিঃ পরা” অর্থাৎ, একই শব্দ বহুবার উচ্চারিত হলে ধ্বনি মাত্র বৃদ্ধি হয়; শব্দ বা শব্দ কথিত বস্তুর বৃদ্ধি ঘটে না। পুনঃ পুনঃ গো-শব্দ উচ্চারিত হলে, নাদ বা কোলাহল বৃদ্ধি হয় বটে; কিন্তু বস্তুপক্ষে কোনরূপ সংখ্যাধিক্য হয় না। সুতরাং শব্দের নিত্যত্ব অবিসম্বাদিত।

পূর্ব্বোক্ত বিষয়ে অন্যান্য যুক্তি-

মীমাংসা দর্শন শব্দের নিত্যত্ব প্রমাণের জন্য আরও কতগুলি যুক্তি নির্দ্দেশ করেছেন। তারই পাঁচটি যুক্তি এখানে তুলে ধরা হল।

প্রথম- “নিত্যস্তু স্যাৎ দর্শনস্য পরার্থত্বাৎ” অর্থাৎ, যখন উচ্চারণ মাত্র শব্দের অর্থ পরিগ্রহ হয়, শব্দ বিনষ্ট হয় না, তখন শব্দকে নিত্য বলাই সঙ্গত। শব্দ যদি নিত্য না হোত, শব্দের যদি অর্থবোধ কেউ না করতে পারত, তাহলে শব্দ উচ্চারণ মাত্রেই ধ্বংসপ্রাপ্ত সুতরাং অনিত্য বলে অভিহিত হতে পারত। শব্দের স্থিতি মানলেই নিত্যত্ব স্বীকার করতে হয়। দ্বিতীয়- “সর্বত্র যৌগপদ্যাৎ” অর্থাৎ, ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি শব্দের একরকম অর্থ পরিগ্রহ করতে পারেন; সমভাবে অভ্রান্তরূপে ভিন্ন ভিন্ন জনের অর্থবোধ ঘটে; এই জন্যই শব্দ নিত্য ও এক। তৃতীয়,- “সংখ্যাভাবাৎ” অর্থাৎ, শব্দের ক্ষয় বৃদ্ধি নেই। বার বার উচ্চারণ হলেও শব্দ একই থাকে। চতুর্থ- “অনপেক্ষত্বাৎ” অর্থাৎ, শব্দ বিনষ্ট হওয়ার কোনও হেতুবাদ দেখা যায় না। সুতরাং শব্দ অনিত্য নয়-নিত্য। পঞ্চম- “লিঙ্গদর্শনাচ্চ” বেদ আদি শাস্ত্রে শব্দকে নিত্য বলে চিহ্নিত করা হয়েছে বলে, শব্দের নিত্যত্ব স্বীকার করতে হয়। শ্রুতি যাকে নিত্য বলে ঘোষণা করেছেন, শাস্ত্র যার নিত্যত্ব অঙ্গীকার করেন, তাই নিত্য। সুতরাং শব্দ মূলাধার ‘বেদ’ নিত্য বলে সপ্রমাণ হয়। শব্দের নিত্যত্ব সম্বন্ধে আরও বিবিধ বিতর্ক উত্থিত হয়। বেদে “ববরঃ প্রাবাহণিরকাময়ত” ইত্যাদি মন্ত্র আছে। কেউ কেউ এর অর্থ এভাবে নিষ্পন্ন করেন যে, ববর নামক কোনও মনুষ্য প্রাবাহণি বায়ুকে কামনা করেছিল। এমন অর্থের ফলে, সেই অনিত্য ববরের পরবর্ত্তী কালে বেদমন্ত্র রচিত হয়েছিল, প্রতিবাদকারী এরূপ প্রতিপন্ন করেন। তাহলে, বেদের নিত্যত্ব স্বতঃই অপ্রমাণিত হচ্ছে। কিন্তু মীমাংসকগণ এ সংশয়ের নিরসন করে গেছেন। অনিত্য দর্শনরূপ উক্ত আশঙ্কার উত্তরে তাঁরা সূত্র করে গেছেন, “পরন্তু শ্রুতিসামান্যমাত্রম”; অর্থাৎ, ববর আদি শব্দ দ্বারা কোনও মনুষ্যকে বুঝায় না, পরন্তু উহা ধ্বনিমাত্র; অর্থাৎ, ববর ধ্বনি বিশিষ্ট প্রবহমাণ বায়ুকে ঐস্থানে লক্ষ্য করা হয়েছে। বায়ুপ্রবাহের অনিত্যত্ব কে প্রচার করবে? সুতরাং এসকল সংশয়-প্রশ্নেও বিঘ্ন ঘটতে পারে না। বেদের নিত্য অনিত্য প্রশ্ন মীমাংসা প্রসঙ্গে আর একটি গুরুতর তর্ক উঠে থাকে। বেদে ইন্দ্র মরুৎ আদিত্য রুদ্র প্রভৃতির নাম দেখা যায়। কারও উৎপত্তি না হলে তার নাম হবে কি প্রকারে? মনে করুন, দেবদত্তের পুত্রের নাম যজ্ঞদত্ত; পুত্রের উৎপত্তি হয়েছিল বলেই তার নামকরণ হয়। সুতরাং ইন্দ্র আদি দেবগণের উৎপত্তি স্বীকার করতে হয়। উৎপত্তি স্বীকার করলে, অনিত্যত্ব অস্বীকার করা যায় না। এই সকল অনিত্য দেবাদির নাম যখন বেদে দেখা যায়, তখন বেদ কেন না অনিত্য হবে? এই প্রশ্নের উত্তরে মীমাংসকেরা বলেন, নিত্য ও অনিত্য দুই ভাবেই দেবগণের অধিষ্ঠান সপ্রমাণ হয়। তাঁরা যখন দেহধারণ করেন, তখন তাঁদের কে অনিত্য বলতে পারি। যা আকৃতি অবয়ব বিশিষ্ট, তা অবশ্যই বিনাশশীল। কিন্তু যখন ইন্দ্র আদি দেব-বিষয়ক স্মৃতি বা জ্ঞানে প্রকাশ পায়, তখন তার নিত্যত্ব স্বীকার করতে হয়। পদার্থ ও পদার্থ বিষয়ক জ্ঞানে স্বাতন্ত্র্য আছে। পদার্থ ধ্বংসশীল; কিন্তু তদ্বিষয়ক জ্ঞান অবিনাশী-নিত্য। ‘রাম’ বলে সম্বোধন করলাম; এটা ব্যক্তিবিশেষকে বুঝাল; রাম নামধারী কোনও ব্যক্তি সামনে আসলেন। সে ব্যক্তি নশ্বর, সে ব্যক্তি ধ্বংসশীল। কিন্তু সেই ‘রাম’ ধ্বংস হওয়ার পূর্বে ও পরে, তাঁর বিষয়ে একটি জ্ঞান আমাদের হৃদয়ে বদ্ধমূল থাকে। সে জ্ঞান তিনি যেমন রূপবান গুণবান বুদ্ধিমান ছিলেন, তাঁর কেমন আকৃতি প্রকৃতি ছিল ইত্যাদি। ব্যক্তি ‘রাম’ ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও তাঁর সম্বন্ধে সেই সে জ্ঞান, তা ধ্বংস হয় না। এই হিসাবে রাম ধ্বংস প্রাপ্ত হলেও রাম নাম অবিনাশী নিত্য। বেদে যে ইন্দ্র আদি দেবতার নাম উল্লেখ দেখতে পাই, তা ইন্দ্র আদি দেব-বিষয়ক জ্ঞান। সুতরাং তা নিত্য হবে না কেন? অতএব বেদের নিত্যত্ব অবিসংবাদিত।

২। বেদের প্রামাণ্য বিষয়ে বিতর্ক ও মীমাংসা।

বেদ বাক্যের প্রামাণ্য বিষয়ে দর্শন রচনাকারদের মস্তিষ্ক নানাভাবে আলোড়িত হয়েছে। মহর্ষি গৌতম ন্যায়-দর্শনে পূর্বপক্ষ ও উত্তরপক্ষ রূপে সে সন্দেহের নিরসন করে গেছেন। গৌতম সূত্রে পূর্বপক্ষ রূপে বেদের প্রামাণ্য বিষয়ে সন্দেহ উপস্থাপন করা হয়েছে,- “তদপ্রামাণ্যমনৃতব্যাঘাত পুনরুক্তদোষেভ্যঃ।” অর্থাৎ, বেদ যে অপ্রমাণ, তার কারণ, উহাতে অসত্য অর্থাৎ মিথ্যাবাদ, ব্যাঘাত এবং পুনরুক্তি দোষ আছে। বেদবাক্য যে অসত্য, তার নিদর্শন-স্বরূপ টীকাকারেরা বলেন যে, বেদে লেখা আছে, পুত্রেষ্টি যাগ করলে পুত্রসন্তান লাভ হবে; কিন্তু কার্য্যতঃ সর্বত্র তার সাফল্য দেখা যায় না; সুতরাং বেদবাক্য মিথ্যা বলে প্রতিপন্ন হয়। বেদ বাক্য যে ব্যাঘ্যাতমূলক, তার দৃষ্টান্তস্থানে উল্লেখ করা হয় যে, বেদের কোথাও বলা আছে- উদয় কালে হোম করবে, কোথাও বলা হয়েছে,- অনুদয় কালে হোম করবে; এবং তাতে এক কালের প্রসঙ্গে অন্যকালের নিন্দাও দেখতে পাওয়া যায়। সুতরাং ব্যাঘাত দোষ ঘটছে। এমন আরও দেখা যায়, পরব্রহ্ম সম্বন্ধে ও শ্রুতিবাক্যের ঐক্য নেই। শ্রুতিতেও কোথাও আছে,- “একমেবাদ্বিতীয়ং ব্রহ্ম”, আবার কোথাও আছে, “দ্বে ব্রহ্মণী বেদিতব্যে পরঞ্চাপমেব চ।” অর্থাৎ, একটিতে অদ্বৈতবাদ, অপরটিতে দ্বৈতবাদ বিঘোষিত হয়েছে। পুনরুক্তির তো কথাই নেই। একই কথা বেদে পুনঃ পুনঃ উক্ত হয়েছে। এভাবে পূর্ব্বপক্ষ ঘোষণা করে, মহর্ষি গৌতম নিজেই তা খণ্ডন করেছেন। বেদবাক্য যে মিথ্যা নয়, তারসম্বন্ধে তিনি বলছেন,- “ন কর্ম্মকর্ত্তৃসাধনবৈগুণ্যাৎ।” তাঁর মতে, তিনটি কারণে বৈদিক কর্মে ফল লাভ হয় না। প্রথমতঃ কর্মকর্তা অনধিকারী; দ্বিতীয়ত, মন্ত্রের উচ্চারণে দোষ; তৃতীয়তঃ, বিধিবিহিত কর্ম অনুষ্ঠান। এই তিনটিই অভীষ্ট ফলে অন্তরায়-সাধক। উপযুক্ত কর্ম না করলে ফলের আশা কিভাবে করা যেতে পারে? সুতরাং বেদবাক্য মিথ্যা নয়; কর্মকারীর কর্মদোষেই কর্ম অনুষ্ঠান পণ্ড হয়ে থাকে। কালাকাল ঘটিত ব্যাঘাত দোষ বিষয়ে গৌতমের উত্তর,- উদয় ও অনুদয় উভয় কালই হোম আদির পক্ষে প্রশস্ত বটে; কিন্তু এককালে সঙ্কল্প করে, অন্যকালে কর্তব্য করলে অভীষ্ট লাভে বিঘ্ন ঘটতে পারে। মন্ত্রের এটাই উদ্দেশ্য। ব্রহ্ম সম্পর্কেও ‘তিনি এক’ ‘তিনি দুই’ এই যে অদ্বৈত ও দ্বৈতবাদ দেখা যায়, তারও কারণ, -জীবের জ্ঞান বৈগুণ্য। জীবের যখন অজ্ঞান অবস্থা, জীব যখন আত্মা-পরমাত্মার অভেদভাব বুঝতে পারে না; তখন আপনাকে ও ব্রহ্মকে দুই বলে মনে করে। যখন তার তত্ত্ব-জ্ঞান উপস্থিত হয়, সে তখন সর্ব্বত্রই ব্রহ্ম ভাব উপলব্ধি করে। জীবের সেই অবস্থাদ্বয় বুঝানোর জন্যই দ্বৈতাদ্বৈতবাদ প্রসঙ্গ।

বেদের প্রামাণিক বিষয়ে এতে ব্যাঘাত ঘটার কি আছে? পুনরুক্তি সম্বন্ধে গৌতম বলেছেন- প্রয়োজন বুঝানোর জন্য যে বাক্য বার বার উচ্চারিত হয়, তা কদাচ পুনরুক্তি দোষ মধ্যে গণ্য হতে পারে না। পাছে ভ্রান্তি বশে জীব কর্তব্য ভ্রষ্ট হয়, তাই তাকে উদ্বোধিত করার জন্য বেদে কোনও কোনও বিষয় একাধিকবার উল্লেখ করা হয়েছে। উহা জীবের মঙ্গলার্থ-প্রযুক্ত, সুতরাং উহা পুনরুক্তি-দোষ-দুষ্ট নয়। যা আবশ্যক বা যা একান্ত করণীয়, সে সম্বন্ধে একাধিক বার উপদেশ দেওয়া হলে, সে উপদেশ হৃদয়ে বদ্ধমূল হতে পারে এবং তার দ্বারা সফলতা আনয়ন করে। সেই উদ্দেশ্যেই এক এক উপদেশ বার বার প্রদত্ত হয়েছে। তাকে দোষ বলা যায় না।

বেদের প্রামাণ্য ও নিত্যত্ব বিষয়ে-

অসত্য, ব্যাঘাত, পুনরুক্তি-ত্রিবিধ দোষ খণ্ডন করে গৌতম নিজমত স্থাপন করেছেন। তিনি বলেছেন- “মন্ত্রায়ুর্ব্বেদবৎ চ তৎপ্রামাণ্যং আপ্তপ্রাম্যাণ্যাৎ।” অর্থাৎ, প্রণেতার উপদেশ যথার্থ বলেই আয়ুর্ব্বেদ-শাস্ত্র প্রমাণ মধ্যে গণ্য হয়। তেমনি বেদকর্তা যথার্থবাদী বলে বেদের বাক্য প্রামাণ্য বলতে হয়। এ বিষয়ে বৃত্তিকারের উক্তি পাঠ করলে, বিষয়টি পরিস্কার হতে পারে।

“আপ্তস্য বেদকর্ত্তুঃ প্রামাণ্যাৎ যথার্থোপদেশকত্বাৎ বেদস্য তদুক্তত্বমর্থাৎলব্ধং। তেন হেতুনা বেদস্য প্রামাণ্যমনুমেয়ং। তত্র দৃষ্টান্তমাহ। মন্ত্রো বিষাদিনাশকঃ। আয়ুর্ব্বেদভাগশ্চ বেদস্য এব। তত্র সংবাদেন প্রামাণ্যগ্রহাৎ তদৃষ্টান্তেন বেদত্বাবচ্ছেদেন প্রামাণ্যমনুমেয়ং।”

যথার্থ উপদেশ প্রদত্ত হয়েছে, সত্যবাণী বিঘোষিত আছে, এজন্য বেদবাক্য প্রমাণরূপে পরিগৃহীত হয়ে থাকে। মন্ত্র-বিষ আদি নাশক; আয়ুর্ব্বেদ-বেদেরই অন্তর্গত। আয়ুর্ব্বেদ-শাস্ত্রের ফল প্রত্যক্ষ সম্যক দেখা যায়। সুতরাং আয়ুর্ব্বেদ প্রমাণ মধ্যে পরিগণিত। বেদও তেমনি প্রমাণ। বেদকে যে নিত্য ও প্রমাণ বলা হয়, তার আরও কারণ এই যে, বেদে অতীত অনাগত মন্বন্তর সম্প্রদায় অভ্যাস ও প্রয়োগ অবিচ্ছিন্ন আছে। বেদের উপদেশ যথার্থ। বহুকাল প্রচারিত হেতু বেদের নিত্যত্ব এবং এতে সত্যবাক্য আছে বলেই তা প্রামাণ্য। এ বিষয়ে বৃত্তিকার বাচস্পতি মিশ্রের উক্তি; যথা,-

“মন্বন্তরযুগান্তরেষু চ অতীতানাগতেষু সম্প্রদায়াভ্যাসপ্রয়োগাবিচ্ছেদো বেদানাং নিত্যত্বং।

আপ্তপ্রামাণ্যাৎ চ প্রামাণ্যং। লৌকিকেষু শব্দেষু চৈতৎ সমানং।”

এভাবে ন্যায়দর্শন বেদের প্রামাণ্য স্থাপন করে গেছেন। মীমাংসকেরা বেদের নিত্যত্ব ও প্রামাণ্য বিষয়ে আরও একটি যুক্তির অবতারণা করেন। অনেক সময় বিতর্ক উঠে থাকে, -শব্দের সাথে অর্থের একটি কল্পিত সম্বন্ধ আছে। সে সম্বন্ধ সঙ্কেতাত্মক, অর্থাৎ বোধ্য-বোধক ভাবমূলক। কল্পিত সেই সম্বন্ধ নিয়েই শব্দ ব্যবহৃত হয়। কল্পিত সেই সম্বন্ধ যে অনেক সময় ভ্রান্তিমূলক হয়, ঝিনুকে রূপার জ্ঞানই তার প্রমাণ। শব্দে যখন সত্যের অপলাপ অসম্ভব নয়, তখন বেদবাক্য-সকল কল্পনা সঙ্কেতাত্মক শব্দ বলে নিরর্থক ও অপ্রামাণ্য হতে পারে। এভাবে পূর্বপক্ষ স্থাপন করে, মীমাংসকগণ খণ্ডনের জন্য একটি সূত্রের অবতারণা করেছেন। এ সম্বন্ধে মীমাংসা দর্শনের একটি সূত্র ও তার ভাষ্য নিচে তুলে ধরা গেল; যথা-

ঔৎপত্তিকস্তু শব্দস্য অর্থেন সহ সম্বন্ধস্তস্য জ্ঞানমুপদেশঃ

অব্যতিরেকশ্চ অর্থে অনুপলব্ধে তৎপ্রমাণং বাদরায়ণস্য।

শব্দের ও অর্থের সম্বন্ধ অর্থাৎ বোধ্য-বোধক ভাব স্বাভাবিক ও অনিত্য। তাতে যে অস্বাভাবিকতা বা অনিত্যতা সূচিত হয়, তা বিভ্রম বা অজ্ঞানতানিবদ্ধন। ঝিনুকে রূপার জ্ঞান বিভ্রমেরই পরিচায়ক। ঝিনুক শব্দে ও রূপা শব্দে যে অর্থ উপলব্ধ হয়, সে শব্দের অর্থ অবিকৃতই আছে;  ভ্রান্তি তার অর্থ-বৈপরীত্য ঘটেছে মাত্র। এ ভাবে বিচার করলে, শব্দ ও তার অর্থ নিত্য ও স্বাভাবিক বলেই প্রতিপন্ন হয়। বেদবাক্য প্রকৃত ধর্মজ্ঞান শিক্ষা দেয়। বেদবাক্য- প্রত্যক্ষ আদি প্রমাণ নিরপেক্ষ অজ্ঞাত বিষয়ের অভ্রান্ত উপদেশ প্রদান করে। সুতরাং বেদ নিত্য ও প্রামাণ্য।

প্রামাণ্যে অন্যান্য সংশয়-

বেদের প্রামাণ্য ও অপ্রামাণ্য বিষয়ে আরও যে সকল বিচার-বিতর্ক উপস্থিত হয়, তারও কতকগুলি উল্লেখ করছি। প্রমাণের দুইটি লক্ষণ সাধারণতঃ বলা হয়। যার দ্বারা সম্যক্‌ অনুভব সাধন হয়, অর্থাৎ যা ভ্রমশূন্য পূর্ণজ্ঞানের প্রকাশক, তাই প্রমাণ। প্রমাণের এই এক লক্ষণ। আর এক লক্ষণ- যা অনধিগত বা অজ্ঞাত বিষয় জ্ঞাপন করে, তাকেই প্রমাণ বলা হয়। প্রমাণ-সম্বন্ধে এই দুই লক্ষণ, দুই সম্প্রদায় কর্তৃক নির্দ্দিষ্ট হয়ে থাকে। পূর্বপক্ষ রূপে নৈয়ায়িকগণ বেদে ঐ দুই লক্ষণেরই অভাব ঘোষণা করেন। কতকগুলি বেদমন্ত্র বোধগম্য হয় না। যা বোধগম্যই নয়, তাতে আর কি জ্ঞান উন্মেষ সম্ভপর? মন্ত্রে আছে- (১) “সৃণ্যেব জর্ভরী তুর্ফরী তু”, (২) “অম্যকসাৎ ইন্দ্রঋষ্টিঃ”, (৩) “যাদৃশ্মিন্ধায়ি তমপস্যয়াবিদদ্‌”, (৪) “আপান্তমন্যুস্তৃপলপ্রভর্ম্মা”, ইত্যাদি। এ সকলের অর্থ পরিগ্রহ হয় না। যার অর্থবোধ হয় না, তার প্রামাণ্য কিভাবে স্বীকার করা যেতে পারে? একটি মন্ত্র আছে, -“অধঃস্বিদাসীদুপরিস্বিদাসীৎ”; অর্থাৎ- উপরে কি নীচে? মন্ত্রে এই ভাব ব্যক্ত থাকলেও, উহা স্থাণূ-সম্বন্ধে কি পুরুষ সম্বন্ধে প্রযুক্ত হয়েছে, তাতে সন্দেহ আসে। সুতরাং ঐ মন্ত্র প্রমাণ-স্বরূপ গ্রহণ করতে পারা যায় না। আবার অনেক স্থানে অচেতন পদার্থকে চেতনের ন্যায় সম্বোধন করা হয়েছে; যথা- (১) “ওষধে ত্রায়স্বৈনম্‌”; অর্থাৎ হে ওষধে! একে উদ্ধার কর; (২) “স্বধিতে মৈনং হিংসীঃ” অর্থাৎ হে ক্ষুর! এর প্রতি হিংসা করবে না; (৩) “শৃণোত গ্রাবাণ” অর্থাৎ হে পাষাণগণ তোমরা শ্রবণ কর; (৪) “আপ উন্দস্তু” অর্থাৎ হে জল! মস্তকের ক্লেদ দূর কর; (৫) “শুভিকে শির আরোহ শোভয়ন্তী মুখং মম” অর্থাৎ হে শুভিকে(টোপর)! আমার মুখের শোভা বর্ধন করতে মস্তকে আরোহণ কর। এই সকল স্থানে অচেতন পদার্থকে চেতন পদার্থ রূপে সম্বোধন করায়, মন্ত্রসমূহ অপ্রামাণ্য প্রতিপন্ন হয়। কোথাও ‘দুই চন্দ্র’ (দ্বৌ চন্দ্রমসৌ), কোথাও রুদ্র এক-দ্বিতীয় নাই (এক এব রুদ্রো ন দ্বিতীয়োহবতহস্থ) কোথাও হাজার হাজার রুদ্র পৃথিবীতে আধিপত্য করছেন (সহস্রাণি সহস্রশো যে রুদ্রা অধিভূম্যাম); এমন উক্তি আছে। এই সকল পরস্পর বিরুদ্ধ বাক্য প্রমাণ পক্ষে বিশেষ বিঘ্ন উপস্থিত করে। যদি কেউ বলেন,- “আমি যাবজ্জীবন মৌন আছি;” তাঁর সে বাক্য যেমন তাঁর মৌনতার বিঘ্ন-সাধক, ঐ সকল পরস্পর বিরুদ্ধ ভাবদ্যোতক মন্ত্রসকলও সেরূপ প্রমাণের ব্যাঘাত ঘটিয়ে থাকে। অতএব, বেদবাক্য প্রামাণ্য নহে।

সকল সংশয় নিরসনে।

পূর্ব্বোক্ত সংশয়-প্রশ্ন-সমূহের উত্তর মীমাংসক-সম্প্রদায়গণ প্রদান করে গেছেন। পূর্বপক্ষরূপে প্রশ্নগুলি উত্থাপন করে, উত্তরপক্ষরূপে তাঁরা যে তার উত্তরদান করেছেন, তারই আভাষ এখন প্রদান করা যাচ্ছে। যে সকল মন্ত্রের অর্থ হয় না বলেই বেদ বিরোধীগণ নির্দ্দেশ করেন, সেই সকল মন্ত্রের অর্থ যাস্কের “নিরুক্ত” গ্রন্থে বুঝানো হয়েছে। যাঁরা তা অবগত নন, তাঁরাই ঐ সকল মন্ত্রের উল্লেখ দেখে বেদের প্রামাণ্য পক্ষে দোষ প্রদর্শন করেন। এই উপলক্ষ্যে মীমাংসকদের একটি সূত্র দেখা যায়। সূত্রটি এই; “সতঃ পরমবিজ্ঞানম,।” অর্থাৎ পরম জ্ঞান লাভ হলেই, বিদ্যমান পদার্থের স্বরূপ উপলব্ধ হয়; অজ্ঞ জন অজ্ঞানতা নিবন্ধন সে জ্ঞান লাভ করতে পারে না। ‘জর্ভরী তুর্ফরী তু’ শব্দের অর্থ পালনকর্ত্তা সংহারকর্ত্তা। ‘জর্ভরী তুর্ফরী’ অশ্বিদ্বয়কে বুঝানো হয়ে থাকে। ঐ কারণেই সূক্তটির নাম আশ্বিন সূক্ত। অন্ধব্যক্তিরা যে বিশাল স্তম্ভ পর্য্যন্তও দৃষ্টি করতে সমর্থ নয়, সে দোষ স্তম্ভের নয়, সে দোষ অন্ধেরই। কেউ অর্থ বুঝল না বলে, বেদবাক্য যে অর্থহীন হবে, তার কোনই হেতু নির্দ্ধারণ করতে পারা যায় না। “অধঃস্বিদাসীৎ” ইতি মন্ত্রের অর্থ-পরবর্তী মন্ত্র পাঠ করলে উপলব্ধ হয়। ঐ অংশের স্থূল অর্থ- উপরে বা নীচে। উহা পরম পুরুষকে লক্ষ্য করে প্রযুক্ত হয়েছে। এতে উর্দ্ধে ও অধঃদেশে সর্ব্বত্র তাঁর বিদ্যমানতা প্রকাশ পেয়েছে। ওষধি, ক্ষুর, পাষাণ প্রভৃতিকে সম্বোধন করে যে সকল্প মন্ত্র উক্ত হয়েছে, তার সমুদায়ে জড় বা অচেতন পদার্থকে লক্ষ্য করা হয় নি; পরন্তু এদের অধিষ্ঠাত্রী দেবতাগণের উদ্দেশেই ঐ সকল মন্ত্র প্রযুক্ত হয়েছে। ঐ সকল মন্ত্র তন্ময়ত্ব ভাব জ্ঞাপক। বিশ্বেশ্বরের বিশ্বরূপে বিরাজমানতাই এর লক্ষ্য। যদি কেউ আপন স্বর্গীয় পিতৃদেবের প্রতিমূর্ত্তি চিত্রপট লক্ষ্য করে ভক্তিভরে প্রণাম করেন, সে প্রণাম কখনই চিত্রপটের উদ্দেশে নয়; সে প্রণাম, তাঁর পূজ্যপাদ পিতার উদ্দেশেই বিহিত হয়। সেরূপ ওষধি, পাষাণ বা ক্ষুর প্রভৃতির সম্বোধনে যে সকল মন্ত্র দেখতে পাই, তাদের অধিষ্ঠানভূত বিশ্বপাতাই সেই সকল মন্ত্রের লক্ষ্য। উত্তর-মীমাংসায় মহর্ষি বাদরায়ণ “অভিমানিব্যপদেশস্তু” এই সূত্রে এই সংশয়ের নিরসন করে গেছেন। সাধারণ-দৃষ্টিতে দুইটি মন্ত্র পরস্পর বিরুদ্ধ ভাবাপন্ন বলে বোধ হলেও, একটু সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখলে সে ভাব দূর হতে পারে। শব্দের ও বাক্যের অর্থ দুইরূপ দৃষ্ট হয়। এক অর্থ- লৌকিক; অপর অর্থ-ব্যবহারিক। পিতা ও মাতা এই দুই শব্দের সাধারণ অর্থ সকলেই অবগত আছেন। এই দুই শব্দে পালনকর্ত্তা পিতা এবং স্নেহময়ী জননী অর্থাৎ পুরুষ ও নারী স্বতন্ত্রভাবে দুই জনকে বুঝিয়ে থাকে। কিন্তু আবার এমনও দেখা যায়, ঐ দুই শব্দ একই উদ্দেশ্যে একই ব্যক্তির প্রতি প্রযুক্ত হয়েছে। লোকে সাধারণতঃ আপন উত্তমর্ণকে ও ভূস্বামীকে “আপনি আমার মা-বাপ” বলে সম্বোধন করে থাকে। সে ক্ষেত্রে আমরা ‘মা-বাপ’(মাতা-পিতা) শব্দদ্বয়ের লৌকিক অর্থ স্ত্রী ও পুরুষ-রূপে পরিকল্পিত হলেও, ঐরূপ ক্ষেত্রে সম্বধিত ব্যক্তিতে পিতার পালকতা ও মাতার স্নেহ-মমতা একাধারে বিদ্যমান আছে, ইহাই বুঝতে হবে। সেরূপ, “এক রুদ্র দ্বিতীয় নাই’ এবং ‘সহস্র সহস্র রুদ্র আধিপত্য করছেন’ এবম্বিধ বিপরীত ভাবসম্পন্ন মন্ত্রে কখনই বেদ-প্রামাণ্যে বিঘ্ন ঘটতেছে না। কেন না, ঐ অংশের সূক্ষ্ম অর্থ এই যে, সেই যে ব্রহ্ম-যিনি রুদ্ররূপে সম্পূজিত হন, তিনি এক হয়েও বহু এবং বহু হয়েও এক। যোগ প্রভাবে মানুষ বহুরূপ, ধারণ করতে সমর্থ হয়। সেখানে একে যেমন বহুত্বের প্রকাশ অসম্ভব হয় না, এ ক্ষেত্রে সেরূপ বিবেচনাও করা যেতে পারে। অতএব, তাঁহাকে কখনও একরূপে, কখনও বহুরূপে পরিচিত করায়, বেদপ্রামাণ্যে কোনই দোষ ঘটে না।

৩। অপৌরুষেয়ত্ব বিষয়ে বিতর্ক ও মীমাংসা। বেদ যে পৌরুষেয় তার পক্ষে যুক্তি-

বেদের অপৌরুষেয়ত্ব প্রমাণ পক্ষে প্রধানতঃ ত্রিবিধ যুক্তির অবতারণা দেখতে পাই। এক পক্ষ বেদকে সাধারণ মানুষের রচনা বলে ঘোষণা করেন। দ্বিতীয় পক্ষ একে অভ্রান্ত পুরুষের রচনা বলেন। তৃতীয় পক্ষ উহা ঈশ্বর-প্রণীত বলে সিদ্ধান্ত করেন। কালিদাস ‘রঘুবংশাদির’ রচয়িতা; ‘উত্তররাম চরিত’ প্রভৃতি ভবভূতির রচনা; বেদও তেমনি পুরুষ বিশেষের রচনা বলে বিতর্ক উপস্থাপন হয়। সাধারণ গ্রন্থ প্রভৃতি দেখে যেমন তার প্রণেতার বিষয় মনে আসে, বেদ দেখেও সে ভাব মনে আসবে না কেন? এই প্রথম পক্ষের সিদ্ধান্ত। আবার, নৈয়ায়িকগণ এক ভাবে, বৈশেষিক-দর্শন আর এক ভাবে এবং বেদান্ত অন্য আর এক ভাবে এ বিষয়ে অভিমত ব্যক্ত করে গেছেন। নৈয়ায়িকগণ বলেন- ‘বেদকর্ত্তা যথার্থবাদী হতে পারেন, বেদ অভ্রান্ত পুরুষের প্রণীত হতে পারে; কিন্তু উহা যে কারও রচনা নয়, তা বলা যেতে পারে না। কুম্ভকার ঘট প্রস্তুত করল; সে স্থানে ‘ঘট’ প্রস্তুত করল’ এই বাক্য নিশ্চয়ই সত্য। বেদে সেরূপ সত্য আছে বলেই উহা অভ্রান্ত-পুরুষের রচনা বলা যেতে পারে; কিন্তু উহা অপৌরুষের অর্থাৎ কারও রচিত নয় বলা যেতে পারে না। বাক্য অভ্রান্ত হলেই যে তা নিত্য ও অপৌরুষেয় হবে, তার কোনও কারণ নাই। তবে বেদ যখন অভ্রান্ত ও সত্যস্বরূপ, উহা ভ্রান্ত মানুষের রচনা হতে পারে না; উহা অভ্রান্ত-পুরুষের-ঈশ্বরের রচনা। ঈশ্বরের রচনা বলেই উহার প্রামাণ্য। তাছাড়া এর অপৌরুষেয়ত্ব নেই। বৈশেষিক-দর্শনের মতও অনেকাংশে ঐরূপ ভাবদ্যোতক। দর্শনকার সূত্রে(প্রথম অধ্যায়, প্রথম আহ্নিক, তৃতীয় সূত্র) বলেছেন,- “তদ্বচনাদাম্নায়স্য প্রামাণ্যম্‌।” অর্থাৎ বেদ ঈশ্বরবাক্য, অতএব প্রমাণ। অর্থান্তরে, বেদ ধর্ম-প্রতিপাদক ঈশ্বরবাক্য, সুতরাং প্রমাণ। বৈশেষিক-দর্শনের অন্য আর এক সূত্রে বিষয়টি আরও স্পষ্টভাবে বিবৃত দেখি। সেই সূত্র (ষষ্ঠ অধ্যায়, প্রথম আহ্নিক, প্রথম সূত্র)- “বুদ্ধিপূর্ব্বাবাক্যকৃতির্বেদে।” অর্থাৎ, বেদবাক্য রচনা বুদ্ধিপূর্ব্বক হয়েছে। বেদে বিধি নিষেধ রূপ যে সকল বাক্য আছে, তা ধর্ম-মূলক। ধর্মাধর্মের প্রমাণ তাই বেদ। সর্ব্বজ্ঞ ঈশ্বর সে বেদ রচনা করেছেন বলেই তার অভ্রান্ততা। ‘স্বর্গকামো যজেৎ’; অর্থাৎ, যাগযজ্ঞই স্বর্গকামী ব্যক্তির ঈষ্টসিদ্ধির কারণ; ‘গাং মা বধিষ্ঠাঃ’; অর্থাৎ, গো-বধ করিও না; কেননা, ইহা স্বর্গকামী ব্যক্তির ইষ্টসিদ্ধির অন্তরায়;- এই প্রকার যে বেদোক্ত বিধি-নিষেধ, ইহা কি কখনও মানুষে রচনা করতে পারেন? স্বর্গ অপবর্গের কথা সাধারণ মানুষের অধিগম্য নয়। এমন যুক্তির অবতারণা করেই বৈশেষিক দর্শন ধর্মাধর্ম প্রতিপাদ্য বেদকে ঈশ্বরবাক্য বলে ঘোষণা করে গেছেন। যার অসংখ্য শাখা, যার অশেষ সন্মান, বৈশেষিকের মতে, তা অভ্রান্ত-পুরুষের- ঈশ্বরের রচনা ভিন্ন কারও রচনা হতে পারে না। এইমতে, বেদ ঈশ্বর-প্রেরিত এবং মহাজনগৃহীত; আর, তার জন্যই এর প্রামাণ্য। বেদ-বিষয়ে বেদান্ত-দর্শনের যে সিদ্ধান্ত, তাতেও এইপ্রকার অভিমত অভিব্যক্ত। বেদ যে ব্রহ্ম হতে উৎপন্ন হয়েছে, ‘শাস্ত্রযোনিত্বাৎ’ (বেদান্ত-দর্শন, প্রথম পাদ, তৃতীয় সূত্র) সূত্রে এ তত্ত্ব ব্যক্ত। বেদ ব্রহ্ম হতে উৎপন্ন, ব্রহ্মই বেদের সৃষ্টিকর্ত্তা; উক্ত সূত্রে এই অর্থ প্রতিপন্ন হয়। ফলতঃ, সাধারণ পুরুষ বা মনুষ্য নয়; পরম-পুরুষ পরমেশ্বর কর্তৃক বেদ সৃষ্ট হয়েছিল। বেদের পুরুষ-সুক্ত মন্ত্র অনুসারেও বেদকে পৌরুষেয় বলা যেতে পারে। কেন-না, উক্ত সূক্তে বেদ-বিধাতা ভগবানকে ‘সহস্রশীর্ষা পুরুষঃ সহস্রাক্ষঃ সহস্রপাৎ’ অর্থাৎ সহস্র-মস্তক সহস্র চক্ষু ও সহস্র-পাদ-বিশিষ্ট পুরুষ বলা হয়েছে। সেই পুরুষ হতেই যখন বেদ উৎপন্ন, তখন বেদকে অবশ্যই পৌরুষেয় বলেই অঙ্গীকার করতে হয়।

বেদের অপৌরুষেয়ত্বে প্রমাণ-

এই প্রকারে বেদের পৌরুষেয়ত্ব-স্থাপনে যে সকল বিতর্ক উত্থাপিত হয়, বিবিধ যুক্তি দ্বারা তার সমস্ত খণ্ডনের প্রয়াস দেখতে পাই। প্রথমতঃ, কালিদাস ভবভূতির ন্যায় কোনও মানুষ যে বেদ-রচয়িতা ছিলেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় না। কালিদাস ‘রঘুবংশ’ প্রণয়ন করেছিলেন; ভবভূতি কর্তৃক ‘উত্তররামরচিত’ বিরচিত হয়েছিল; -এর সাক্ষ্য পুরুষ-পরম্পরা ক্রমে প্রাপ্ত হওয়া যাচ্ছে। কিন্তু বেদ-প্রণেতার কোনই পরিচয় নেই। কেউ হয় তো মনে করতে পারেন, মধুচ্ছন্দা ঋষি প্রভৃতি যাঁদের নামে বৈদিক সূক্তসমূহ প্রচারিত আছে, তাঁরই বুঝি সেই সেই সূক্তের রচয়িতা। কিন্তু এ বিষয় পূর্ব্বেই প্রতিপন্ন করা হয়েছে যে, তাঁদের কে মন্ত্রের রচয়িতা বলা যেতে পারে না; তাঁরা মন্ত্রের প্রবর্ত্তক মাত্র।  তারপর, বৈশেষিক দর্শনের এবং বেদান্ত-দর্শনের সিদ্ধান্তের আলোচনায় বেদ যে পরমেশ্বর-রচিত বলেই সূচিত হয়, তার দ্বারাও এর পৌরুষেয়ত্ব প্রতিপন্ন হয় না। কেন-না, পুরুষ বলতে – মানুষ বলতে, কর্মফল-হেতুভূত এই জন্মজরামরণশীল দেহধারী জীবকেই বুঝায়। কর্মের ফলে জীবকে নরদেহ ধারণ করতে হয়। সেই নরদেহধারী জীবই সাধারণতঃ পুরুষ নামে খ্যাত। কিন্তু জগৎপাতা জগদীশ্বর সেরূপ পুরুষ নন। আবশ্যক অনুসারে পুরুষ-রূপে আবির্ভূত হলেও, তিনি সাধারণ পুরুষের অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন না; কেনন-না, কর্মফলের অধীন হয়ে, কর্মফলভোগ-হেতু তাঁকে সংসারে আসতে হয় নি; সুতরাং পুরুষ হয়েও তিনি পুরুষাতীত। আর, সে অনুসারে পৌরুষের হয়েও তাঁর রচনা অপৌরুষেয়। এই পৌরুষেয় -অপৌরুষেয় প্রসঙ্গে সাংখ্য মতাবলম্বিদের যুক্তি আবার আরেক প্রকার। তাঁরা বলেন, ‘পুরুষ নিষ্ক্রিয় মুক্ত সৎস্বরূপ। কোনও বিষয়ে তাঁর ইচ্ছাই আসতে পারে না। সুতরাং তিনি যে বেদ রচনা করেছেন, তা কিভাবে বলতে পারি?-ইচ্ছাপূর্ব্বক কোনও কার্য্য করা-বদ্ধ-পুরুষের লক্ষণ। অতএব, বুদ্ধিপূর্ব্বক বেদ রচনা হয়েছে যদি স্বীকার করা যায়, তাহলে পুরুষকে পরমেশ্বরকে বদ্ধ-জীব বলেই স্বীকার করতে হবে। বদ্ধজীবে মুক্ত-সত্য-ভাব কখনই সম্ভবপর নয়। পুরুষ মুক্ত সত্য; সুতরাং বেদ তাঁর রচনা হতে পারে না।’ তবে তাঁর থেকে বেদ কিভাবে উৎপন্ন হতে পারে? সাংখ্যগণ উত্তরে বলেন,- ‘অদৃষ্টবশতঃ স্বয়ম্ভূ ব্রহ্মার নিশ্বাসের ন্যায় বেদের উৎপত্তি হয়েছে। পুরুষ হতে অনুসৃত হলেই যে তা পৌরুষেয় হল, তা বলতে পারি না। সুষুপ্তি-কালে, নিদ্রিত অবস্থায়, মানুষের নিশ্বাস-প্রশ্বাস নির্গত হয়। তাকে কি ইচ্ছাকৃত পৌরুষেয় সংজ্ঞায় অভিহিত হয়ে থাকে। পুরুষ-যিনি পরমপুরুষ, তাঁতে ইচ্ছা ও অনিচ্ছা কিছুরই আরোপ করা যায় না। সুতরাং বেদ পৌরুষেয় নহে। তবে বেদ কোথা হতে আসল? সাংখ্যগণ উত্তরে বলেন,-বেদ অনাদি; বীজাঙ্কুরবৎ। বৃক্ষ আদি, কি বীজ আদি-ইহা যেমন নির্ণয় হয় না; জ্ঞান-রূপ বেদেরও সেরূপ উৎপত্তি ও লয় নির্ণয় হয় না। যা পুরুষ(সাধারণ মনুষ্য) কৃত, তার উৎপত্তি ও বিনাশ আছে। কিন্তু জ্ঞানের আদি-অন্ত কে নির্ণয় করতে পারে?’ সুতরাং বেদ অনাদি অপৌরুষেয়।

ঋগ্বেদ সংহিতা-ভূমিকা-তৃতীয় পরিচ্ছেদ।(দ্বিতীয় ভাগ)

 

ঋগ্বেদ সংহিতা(ভূমিকা-দ্বতীয় পরিচ্ছেদ।)

বেদ-তত্ত্ব যে অতি জটিল, বেদের স্বরূপ বুঝতে গেলে যে তদ্বিষয়ক অনেক আলোচনার আবশ্যক হয়, উপরে-উক্ত ষড়ঙ্গ আদির প্রসঙ্গ অনুধাবন করলে তা হৃদগম্য হতে পারে। সকল জ্ঞানে জ্ঞানী হতে পারলে, সাহিত্য-ইতিহাস-বিজ্ঞান-দর্শন ভূলোকের দ্যুলোকের সকল তত্ত্ব অধিগত হলে, তবে বেদ অধ্যয়নে সফল-কাম হওয়া যায়। বেদপাঠে যে বহু প্রতিবন্ধক বিষয় প্রচার করা হয়, বেদপাঠে-প্রয়োজনীয় অধিকারী অনধিকারী প্রসঙ্গে যে গভীর কূটতত্ত্ব উঠানো-হয়, তার কারণ আর অন্য কিছুই নয়। তার একমাত্র কারণ-অপব্যবহারের আশঙ্কা। যে জন যে সামগ্রীর মর্ম গ্রহণ করতে অক্ষম, তাকে সে সামগ্রী প্রদান করে কি ফল আছে? দুগ্ধপোষ্য শিশু মণি-মাণিক্য পেলে গলাধঃকরণ করতে প্রয়াস পায়। সে জানে না, সে বোঝে না-সে মণিমাণিক্য কি জন্য সমাদৃত হয়। অজ্ঞান শিশু বহু-মূল্য রত্ন প্রাপ্ত হলেও অবহেলায় দূরে নিক্ষেপ করতে পারে। বেদমর্ম বুঝতে যাদের সামর্থ্য নেই, পরন্তু যাঁরা বেদমার্গে অগ্রসর হওয়ার সামান্য সামর্থ্যটুকু পর্য্যন্ত লাভ করতে পারে নাই, তাদের কে বেদ অধ্যয়নে বিরত করাই বিধেয়। কেন-না, হিতে বিপরীত ফল ফলতে পারে। অমৃতের অথবা বিষের ব্যবহার যারা না জানে, তাদের নিকট দুই সামগ্রী দুই বিপরীত ফলই প্রদান করে থাকে। যাঁরা বলেন, ব্রাহ্মণগণ স্বার্থপর ছিলেন বলেই, আপনাদের মধ্যে জ্ঞানের আলোক আবদ্ধ রাখবেন বলেই, বেদ অধ্যয়নে আপামর সাধারণ সকলকে অধিকার দেন নাই; তাঁদের বিভ্রান্ত বলে ঘোষণা করতে পারি। এ বিষয়ে বেদবিৎ জৈনিক মনস্বীর উক্তি উদ্ধৃত করছি। তাতেই বুঝতে পারব, ব্রাহ্মণ-গণ কেন সাম্যবাদী ছিলেন, জগজ্জনের হিতের জন্য সমভাবে তাঁরা কিরকম প্রয়াস পেতেন। সে উক্তি- “আধুনিক সভ্যগণ যে সাম্যভাবের পক্ষপাতী- যে সাম্যভাবের অভাব দেখিয়ে তাঁরা ব্রাহ্মণ্য-ধর্মের প্রতি দোষারোপ করতে বন্ধপরিকর-যে সাম্যভাবের ব্যত্যয় ঘোষণার ফলে বহুতর শূদ্র বংশধর আজ ব্রাহ্মণ গণকে মূল শত্রুভাবে দেখে থাকেন; সেই সামরূপ অতুল্য রত্ন বৈদিককালে এই ব্রাহ্মণগণ কর্ত্তৃক কিরকম বিমুক্তকন্ঠে বিগীত হত, তার পক্ষে অথর্ব্ব-সংহিতার উনবিংশ কাণ্ডের সপ্তম অনুবাকের অষ্টম সূক্তের প্রথম মন্ত্র’ই যথেষ্ট নিদর্শন। যথা,-

অর্থ, ‘হে জগদীশ্বর! দেবদলের মধ্যেই প্রিয়বিধান করিও না, রাজন্যবর্গেই যেন তোমার প্রীতি আবদ্ধ না থাকে; প্রত্যুত সকলের প্রতিই সমভাবে প্রীতিদৃষ্টি কর-কি শূদ্রজাতিতে, কি আর্য্যজাতিতে। এমন স্থান-সমূহে ‘দেব’ শব্দে তপোবিদ্যা প্রভাবে দীপ্তিশালী ব্রহ্মণ্য অনুরক্ত ব্রাহ্মণ অর্থাৎ জ্ঞানী বুঝায়, রাজ শব্দে সামান্য ভূস্বামী প্রভৃতি সম্রাট পর্য্যন্ত ধনী এবং আর্য্য শব্দে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য এই ত্রিবিধ মাননীয় জাতি বুঝায়; আর শূদ্র শব্দে দাস ও দস্যু এই দ্বিবিধ জাতি বুঝতে হবে। সেকালে ম্লেচ্ছ যবন প্রভৃতি দস্যুরাই প্রকারভেদে ছিল। আর্য্যমতে মানবজাতি এই পঞ্চবিধ শ্রেণীতে বিভক্ত বলেই ‘পঞ্চজন’ শব্দটিও মনুষ্য শব্দের পর্য্যায় রূপে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। উপরে-প্রদর্শিত মন্ত্রটি আলোচিত হলে ইহা অনবগত থাকে না যে, প্রাচীন কালের অর্থাৎ বৈদিককালের ব্রাহ্মণগণ কদাপি কিছু মাত্র স্বার্থপর ছিলেন না;-এ জগতে, কেবল জ্ঞানীর বা ব্রহ্মণ-জাতিরই প্রিয়কার্য্য সংসাধিত হোক, অথবা কেবল বলী ও ধনী বা ক্ষত্রিয় বৈশ্যেরই প্রিয় হোক, কিম্বা একমাত্র আর্য্য-জাতিরই মঙ্গল হোক,-তাঁদের এরকম প্রার্থনা ছিল না; প্রত্যুত সাম্যমন্ত্রে দীক্ষিত, মহাসভ্য সেই ব্রাহ্মণগণের এক সময়ে এই প্রার্থনা ছিল যে,- কি জ্ঞানী কি অজ্ঞান কি বলী, কি দুর্ব্বল, কি ধনী কি নির্ধন, কি আর্য্য, কি অনার্য্য-মানুষ-মাত্রের প্রিয় অর্থাৎ অভীষ্ট সংসিদ্ধি হোক। অতঃপর বিবেচনা করা আবশ্যক, এরকম বচনগুলি যাঁদের হৃদয়-কন্দর হতে প্রকাশ পেয়েছে এবং যে সমাজে চিরদিন মন্ত্ররূপে সমাদৃত হয়ে আসছে, সেই মহাত্মদেরকে এবং সেই সমাজকে স্বার্থপর ও বিজাতি-সমুচ্ছেদক বলে নির্ণয় করা কতদূর সঙ্গত? (১২৯৯ সালের ৩০এ ফাল্গুনের অনুসন্ধানে পণ্ডিত প্রবর সত্যব্রত সামশ্রমী মহাশয়ের লেখা প্রবদ্ধ থেকে) ঋগ্বেদের মন্ত্রেও এই সাম্যভাবের বিকাশ দেখতে পাই। সেখানে মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি প্রার্থনা করছেন-হে জগজ্জন! তোমরা অভিন্ন-হৃদয় হয়ে কার্য্যক্ষেত্রে প্রবেশ কর, তোমাদের বাক্য অবিরোধ ও অভিন্ন হোক, তোমাদের মন অবিরোধে পরম জ্ঞান লাভ করুক; সমান মন্ত্র, সমান মন, সমান সমিতি, সমান চিত্ত হয়ে তোমরা কার্য্য কর; তোমাদের আকূতি (মনোভাব-আশা আকাঙ্ক্ষা) এক হোক, হৃদয় এক হোক, অন্তর এক হোক; আর তোমাদের সেই একত্ব প্রভাবে তোমাদের সাহিত্য সুশোভন হয়ে উঠুক। পরম সাম্যভাব- মূলক ঋগ্বেদের(দশম মণ্ডল দ্রষ্টব্য) সেই মন্ত্র নিম্নে উদ্ধৃত করছি; যথা,-

“সংগচ্ছধ্বং সংবদধ্বং সং বো মনাংসিজানতাং।

দেবাভাগং যথাপূর্ব্বে সংজানানাহউপাসতে॥

সমানো মন্ত্রঃ সমিতিঃ সমানী সমানং মনঃ সহচিত্তমেষাং।

সমানং মন্ত্রমভিমন্ত্রয়েবঃ সমানে নবোহবিষা জুহোমি॥

সমানীবহয়াকূতিঃ সমানাহৃদয়ানিবঃ।

সমানমস্তু বো মনোয়থাবঃ সুহাসতি॥”

জ্ঞান কখনও কার ও একায়ত্ত হবার নয়। জ্ঞান-স্বরূপ বেদ কখনও তদ্রুপ বাণী ঘোষণা করে না। সকলই সমান হোক সকলেই সমান জ্ঞানে জ্ঞানী হোক, সকলেই জ্ঞানময়ের দিব্য প্রভাব দর্শন করুক, ভগবানের এই অভিপ্রায়। কিন্তু একটা শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে, একটা ক্রমবিকাশের ধারা বেয়ে, সকলকে অভ্যুদয়ের পথে অগ্রসর হতে হবে। জন্মগ্রহণ করা মাত্র একেবারেই কেউ বাক্‌-শক্তি, চলন শক্তি ও পূর্ণজ্ঞান লাভ করে না। স্তরে স্তরে, সিঁড়ি পর সিঁড়ি অতিক্রম করেই, জ্ঞান-রাজ্যে প্রবেশ করতে হবে। এটাই বিশ্ববিধাতার বিধান বৈচিত্র্য। তিনি সমান ব্যবস্থা রেখেছেন-সকলের জন্য; তিনি সাম্যভাবের বিধান করেছেন-সকলের পক্ষে; তিনি সমভাবে কৃপাপরায়ণ আছেন-সকলের প্রতিই। কিন্তু তাঁর বিধান এই যে, সকলকে একটি নির্দ্দিষ্ট নিয়মের মধ্য দিয়ে  চলতে হবে। সে নিয়ম অতিক্রম করার সাধ্য কারও নেই। সে নিয়ম অনুসারে চলেই জড় অজড় হবে, অচেতন চেতন হবে, মনুষ্যতর প্রাণী মনুষ্যত্ব পাবে, মানুষ দেবত্ব লাভ করতে সমর্থ হবে। বেদ-বিষয়ে অভিজ্ঞতা লাভ করতে হলে, সেরকম একটি নিয়মের মধ্য দিয়েই অগ্রসর হতে হবে। আর এই নিয়ম-সমূহে পরিচালিত হতে হতেই বেদ-রূপ পরম-জ্ঞান অধিগত হয়ে আসবে।


পূর্বেই বলেছি, বেদ জানতে হলে, জানতে হবে-ষড়বেদাঙ্গ, জানতে হবে-ব্রাহ্মণ আরণ্যক উপনিষৎ, জানতে হবে-সংহিতা দর্শন পুরাণ। ফলতঃ তিনিই বেদ অধ্যয়নে অধিকারী, তাঁরই বেদ অধ্যয়ন সার্থক,-যিনি সর্ব্বশাস্ত্রে জ্ঞানলাভ করেছেন, যিনি সর্ব্বশাস্ত্রে পারদর্শী হয়েছেন এবং যাঁর সকল বিদ্যায় অভিজ্ঞতা লাভ হয়েছে। সকল শাস্ত্রই বেদের অনুসারী; সুতরাং সকল শাস্ত্রেই বেদের আলোচনা দেখতে পাই। ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, উপনিষৎ, দর্শন এবং পুরাণ প্রভৃতির আলোচনায় বেদ সম্বন্ধে নানা মত দেখতে পাই। অনেক স্থানে তার এক মতের সাথে অন্য মতের সাদৃশ্য ভাবও পরিলক্ষিত হয়। শতপথ-ব্রাহ্মণে দেখি, যোগীশ্বর যাজ্ঞবল্ক্য বলছেন,-সেই পুরুষ প্রজাপতি, প্রজাসৃষ্টির কামনা করলেন; তাঁর কঠোর তপস্যার ফলে ত্রয়ীবিদ্যা সৃষ্ট হল। সেই ত্রয়ীবিদ্যাই ঋগ্বেদ, সামবেদ ও যজুর্ব্বেদ। ব্রহ্মই সেই ত্রয়ীবিদ্যার প্রতিষ্ঠাতা অর্থাৎ ব্রহ্ম হতেই বেদত্রয় উৎপন্ন হয়েছিল। রূপকে এই বিষয়টি আবার আরেক ভাবে বর্ণনা করা আছে,-

“মনো বৈ সমুদ্রঃ। মনসো বৈ সমুদ্রাৎ বাচাভ্র্যা দেবাস্ত্রয়ীং বিদ্যাং নিরখনন্‌।

মনঃ বৈ সমুদ্রঃ। বাক্‌ তীক্ষাভ্রিঃ। ত্রয়ীবিদ্যা নির্ব্বপণং।”

অর্থাৎ,-মনরূপ সমুদ্র। সেই মনরূপ সমুদ্র হতে বাক্‌রূপ অভ্রি দ্বারা দেবগণ ত্রয়ীবিদ্যা খনন করেছিলেন। পুনশ্চ মনোরূপ সমুদ্র; বাক্‌রূপ তীক্ষ্ণ অভ্রি; তার দ্বারা ত্রয়ীবিদ্যা নির্ব্বপণ করা হয়েছিল।’ ফলতঃ, সৃষ্টিকাম প্রজাপতি পৃথিবী-সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে তিন বেদ সৃষ্টি করেন; -অগ্নি হতে ঋগ্বেদ, বায়ু হতে যজুর্ব্বেদ এবং সূর্য্য হতে সামবেদ নিঃসৃত হয়। ব্রাহ্মণে এই মতই প্রকট দেখতে পাই। উপনিষদের মধ্যে ছান্দোগ্য উপনিষদে ঐ মতেরই প্রতিধ্বনি দেখি। পুরাণ-পরম্পরার মত নানারূপে পল্লবিত। বিষ্ণূপুরাণে দেখা যায়,-ব্রহ্মার প্রথম মুখ থেকে গায়ত্রীছন্দঃ, ঋগ্বেদ, রথস্তর নামক সামবেদ প্রভৃতি উৎপন্ন হয়। তাঁহার দক্ষিণ মুখ থেকে যজুর্ব্বেদ, ত্রিষ্টুভ ছন্দ প্রভৃতি উৎপন্ন হয়। তাঁহার পশ্চিম মুখ হতে সামবেদ, জগতী ছন্দঃ প্রভৃতি নির্গত হয়। তাঁহার উত্তর মুখ হতে অথর্ব্ববেদ, অনুষ্টুপ ছন্দ প্রভৃতি উদ্ভূত হয়েছিল। ব্রহ্মা বেদের উপদেশ অনুসারেই সৃষ্ট-পদার্থের নাম-রূপ-কর্ম আদির ব্যবস্থা স্থির করেছিলেন এ সকল উক্তির নিগূঢ় তাৎপর্য্য থাকলেও স্থূলতঃ বেদ যে সৃষ্টির আদিভূত, তা বেশ বুঝতে পারা যায়। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস, বৈবস্বত মন্বন্তরের দ্বাপর যুগে, বেদকে চার ভাগে বিভক্ত করেছিলেন। সে সময় হতে ঋক, যজুঃ, সাম, অথর্ব্ব-চার বেদ ইহলোকে প্রতিষ্ঠাপন্ন। রূপকের ভাষায় নানারূপে বেদের উৎপত্তি-তত্ত্ব পুরাণ আদি গ্রন্থে বর্ণিত থাকলেও বেদ যে সৃষ্টির আদিভূত, বেদ যে অনাদি অনন্ত কাল নিত্য-সত্যরূপে বিরাজমান, সর্বত্রই তার প্রতিধ্বনি দেখতে পাই। সকল মতেরই সার-নিষ্কর্ষে বেদের অলৌকিকত্ব প্রতিপন্ন হয়।

বেদ-বিভাগ।

বেদ বিভাগ সম্বন্ধে নানা মত প্রচলিত আছে। এক বেদ তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে ‘ত্রয়ী’ নামে পরিচিত হয়েছিল, এবং বেদব্যাস কর্ত্তৃক উহা ঋক্‌, যজুঃ, সাম, অথর্ব্ব চার বিভাগে বিভক্ত হয়েছিল,- এ বিষয়ে আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। এক শ্রেণীর পণ্ডিতগণ বেদকে আর এক ভাবে তিন ভাগে বিভক্ত করেন। তাঁদের মতে-

(১) ক্‌৯প্ত ও কল্প্য ভেদে বেদ দ্বিবিধ;

(২) কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড ভেদে দ্বিবিধ;

(৩) মন্ত্র ও ব্রাহ্মণভেদে দ্বিবিধ।

এ হিসাবে তিন ভাগের মধ্যে ছয় বিভাগ পরিকল্পিত হয়। প্রথম বিভাগের অন্তর্গত ক্‌৯প্ত ও কল্প্য বলতে কি বুঝা যায়? “যা-তু প্রত্যক্ষতঃ প্রতিপদ্যতে সা ক্‌৯প্ত।” যা প্রত্যক্ষ বলে প্রতিপন্ন হয়, তাই ক্‌৯প্ত। যে স্তবস্তুতি অক্ষয়-রচিত অর্থাৎ লেখা হয়েছে, তারই নাম-ক্‌৯প্ত শ্রুতি; কেন-না, সেগুলি প্রত্যক্ষ হয়ে থাকে। ঋক, যজুঃ, সাম, অথর্ব্ব- এই চতুর্ব্বেদ গ্রন্থাকারে নিবদ্ধ। ইহা ক্‌৯প্ত শ্রুতির অন্তর্গত। ক্‌৯প্ত শ্রুতি গ্রন্থভেদে চার প্রকার এবং মন্ত্রভেদে তিন প্রকার। গ্রন্থ-ঋগ্বেদ, যজুর্ব্বেদ, সামবেদ, অথর্ব্ববেদ; আর মন্ত্র-ঋকমন্ত্র, যজুর্ম্মন্ত্র ও সামমন্ত্র। ঐরূপ ক্‌৯প্ত শ্রুতি ব্যতীত আর এক প্রকারের শ্রুতির বিষয় বলা হয়ে থাকে। যা কিছু সত্য সংসারে আছে, যা কিছু সৎকর্ম সংসারে সম্ভবপর, সেগুলি চিরকাল অপরিবর্ত্তিত ভাবে বিদ্যমান রয়েছে। সে সকল নিত্য-সত্য ঐ চতুর্ব্বেদের অন্তর্ভুক্ত না হলেও সেগুলিও বেদ মধ্যে গণ্য। সেই সকলের নাম-কল্প্য-শ্রুতি। বেদ অনন্ত বলে যাঁরা বিশ্বাস করেন, ঐ চতুর্ব্বেদের মধ্যে যাঁরা বেদকে সীমাবদ্ধ করতে প্রস্তুত নন, তাঁরাই কল্প্য-শ্রুতির পরিপোষক। তাঁদের নাম-অনন্তবাদী। তাঁরা বলে থাকেন,- “যা তু স্মৃতিসদাচারাভ্যাং অনুমীয়তে সা কল্প্য-শ্রুতিঃ।” স্মৃতি আর সদাচার দ্বারা যা অনুমান করা যায়, তাকেই কল্প্যশ্রুতি বলে। দেশভেদে, সমাজভেদে, অবস্থাভেদে বিবিধ সদাচার প্রচলিত আছে। সেই সকল সদাচারকে কল্প্যশ্রুতির অন্তর্ভুক্ত হিসাবে গণ্য করা হয়। লোকপাবন মহর্ষিগণ সমাজের শৃঙ্খলা-রক্ষার জন্য বহু বিধি-নিষেধ নিয়ম প্রবর্তন করে গেছেন। সে সকল জন হিতকর বিধান পরম্পরা কল্প্যশ্রুতি মধ্যে গণ্য হয়। দ্বিতীয় বিভাগ-কর্ম্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড নিয়ে। যাগযজ্ঞের উপযোগী চতুর্ব্বেদ ও ব্রাহ্মণ সমূহ কর্মকাণ্ডের অন্তর্গত; এবং উপনিষদ জ্ঞানকাণ্ডের পর্য্যায়ভূক্ত। যাতে কর্মের উপদেশ পাওয়া যায়, তাই কর্ম্মকাণ্ড; আর যা কেবল জ্ঞান উন্মেষকর, তাই জ্ঞানকাণ্ড অন্তর্ভুক্ত। তৃতীয় বিভাগ- মন্ত্র ও ব্রাহ্মণ নিয়ে। “মননাৎ মন্ত্র”; অর্থাৎ যা দ্বারা ইষ্টবস্তুর মনন বা স্মরণ করিয়ে দেয়, তাই মন্ত্র। দেব আদির উপাসনার উপযোগী যে বাক্য বা পদ, তাকেই মন্ত্র বলে। “অগ্নিমীলে পুরোহিতং” ইত্যাদি যে ঋক্‌, উহা উপাসনা-মূলক; সুতরাং মন্ত্র-মধ্যে গণ্য। ব্রাহ্মণ-মন্ত্র-সকলের ব্যাখ্যা-মূলক। যজ্ঞের বিনিয়োগ অর্থাৎ প্রয়োগ বা অর্পণ, ব্রাহ্মণ শিক্ষা দেয়। বেদের ব্রাহ্মণভাগ দ্বিবিধ;- (১)বিধিবাদ ও (২) অর্থবাদ। বিধিভাগ অজ্ঞাত বিষয় সম্বন্ধে জানান দেয়, অপ্রবৃত্ত অননুষ্ঠিত কর্মে প্রবৃত্ত করে। স্তুতিবাদেরই নামান্তর-অর্থবাদ। যে অংশ স্তবস্তুতিমূলক, তাই অর্থবাদের অন্তর্নিবিষ্ট। এই সকল আলোচনায় প্রতিপন্ন হয়,-ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, উপনিষৎ প্রভৃতি নিয়ে বেদ সম্পূর্ণ। উপনিষদ আদিও বেদের অন্তর্ভুক্ত।

বেদ-এ শ্লোক সংখ্যা-বিষয়ে।

ঋগ্বেদ আদি যে চতুর্ব্বেদ বিভাগ, এখন সে প্রসঙ্গে আলোচনা করব। এই চার বেদ আবার বিভিন্ন পণ্ডিতগণ কর্ত্তৃক বিভিন্ন বিভাগে বিভক্ত হয়ে থাকে। সে সকল বিভাগে নানা মতান্তর দেখতে পাই। দৃষ্টান্ত-স্বরূপ বেদের ঋকের ও মন্ত্রের সংখ্যা তুলে ধরছি। ঋকের ও মন্ত্রের সংখ্যা-গণনায় বিভিন্ন পণ্ডিত বিভিন্ন মত প্রকাশ করে গেছেন। এক ঋগ্বেদের ঋক্‌-সংখ্যার বিষয় আলোচনা করলেই বিষয়টি বোধগম্য হতে পারে। সাধারণতঃ ঋগ্বেদের ঋক্‌-সংখ্যা ১০হাজার ৪০২ হতে ১০ হাজার ৬৬২টি বলা হয়। চরণব্যুহ গণনা করে নির্দ্দেশ করেন, -দশ হাজার পাঁচ শত আশিটি ঋক্‌ ঋগ্বেদে সন্নিবিষ্ট আছে। যথা,-

“ঋচাং দশসহস্রাণি ঋচাং পঞ্চশতানি চ। ঋচামশীতিঃ পাদশ্চ তৎপারায়ণমূচ্যতে।।”

কিন্তু অধুনাতন সংস্করণে পণ্ডিতগণ গণনা করে দশ হাজার চারশত সতেরটি ঋক্‌ নির্দ্দেশ করেছেন। এ হিসাবে, একশত তেষট্টি ঋক্‌ লোপপ্রাপ্ত হয়েছে। এরকম অন্যান্য বেদ সম্বন্ধেও মন্ত্র-সংখ্যার হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটেছে। সামবেদের মন্ত্র-সংখ্যা বিষয়ে চরণব্যুহের মত- “অষ্টসামসহস্রাণি সামানি চ চতুর্দ্দশ।” অর্থাৎ, সাম-মন্ত্রের সংখ্যা আট হাজার চৌদ্দ। মন্ত্র ও ব্রাহ্মণ ভাগ নিয়ে যজুর্ব্বেদের মন্ত্র-সংখ্যা-আঠার হাজার। তন্মধ্যে শুক্লযজুর্ব্বেদের মন্ত্র-পরিমাণ-উনিশ শত। অথর্ব্ববেদের মন্ত্র-পরিমাণ-বার হাজার তিন শত। এ সম্বন্ধে চরণব্যুহের(শৌনকের) উক্তি নিন্মে উদ্ধৃত করা গেল; যথা-

“দ্বাদশানাং সহস্রাণি মন্ত্রাণাং ত্রিশতানি চ। গোপথং ব্রাহ্মণং বেদেহথর্ব্বণে শতপাঠকং।।”

কিন্তু অধুনা অথর্ব্ববেদের শৌনক-শাখাতে মাত্র ছয় হাজার পনেরটি ঋক্‌ পাওয়া যায়। প্রতি বেদ আবার বিভিন্ন নামধেয় বিভিন্ন পরিচ্ছেদে বিভিন্ন সময়ে বিভক্ত হয়েছিল, বুঝা যায়। শাখা, উপনিষৎ প্রভৃতি ভেদেও বেদ-চতুষ্টয়ের বিভাগ পরিকল্পিত হয়ে থাকে। এক এক বেদের বিষয় স্বতন্ত্রভাবে আলোচনা করলে, কোন্‌ বেদ কি কি শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হয়েছিল, তা বুঝতে পারা যাবে।


ঋগ্বেদ সংহিতা-ভূমিকা- তৃতীয় পরিচ্ছেদ।(প্রথম ভাগ)


পল্লবগ্রাহিতার(ভাসা ভাসা জ্ঞান) কুফল;- বেদ অধ্যয়নে অশেষ জ্ঞান আবশ্যক; -ষড়বেদাঙ্গ;- শিক্ষা-এতে কি জ্ঞান লাভ করা যায়, তার মর্ম;- কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ;-ঐ সকলের সারমর্ম; পদ, ক্রম, জটা, ঘন প্রভৃতি;- বেদে সাম্যভাব,-ঋগ্বেদের মন্ত্রে সাম্যভাবের বিকাশ; -বেদ বিষয়ে শাস্ত্রগ্রন্থের অভিমত- বিভিন্ন শাস্ত্রে বিভিন্ন মত পরিব্যক্ত;-বেদ বিভাগ,-সেবিষয়ে বিভিন্ন পদ্ধতি; -ঋগ্বেদ, সামবেদ, যজুর্ব্বেদ, অথর্ব্ববেদ;-কোন্‌ বেদে কি কি বিষয় আলোচিত হয়েছে; বেদপরিচয়ে বিবিধ বক্তব্য।]

পল্লবগ্রাহিতার(ভাসা ভাসা জ্ঞান) কুফল-

ভাসা ভাসা জ্ঞান মানুষের সাধারণ প্রবৃত্তি। বিষয়-বিশেষে গভীরভাবে মনযোগী হওয়া- সাধারণতঃ মানুষের রুচি-প্রকৃতি-বিরুদ্ধ। মানুষ সকল বিষয়ই ভাসাভাসা বা উপর-উপর বুঝতে চায়। এই যে বেদ-যে বেদ নিয়ে যুগ-যুগান্ত ধরে অনন্ত-কোটি মানুষের মস্তিষ্ক বিঘূর্ণিত হয়ে গেল, সেই বেদ-বিষয়েও মানুষের সেই পল্লবগ্রাহিতা(ভাসা ভাসা জ্ঞান)-প্রবৃত্তির অসদ্ভাব নেই। বেদ কি এবং বেদে যে কি আছে, সকলেই এক কথায় তার স্থূল-মর্ম জানতে চান। বেদ কি-এক কথায় উত্তর পেলে অনুসদ্ধিৎসু চিত্ত যেন শান্তি লাভ করে। তাই উত্তরও অনেক সময় যথেচ্ছভাবে দিয়ে থাকে। যার যতটুকু অভিজ্ঞতা, তিনি সেরূপ উত্তরই দিয়ে থাকেন। বিশাল মহাসাগরের গভীরতা নির্ণয় করার উদ্দেশ্যে অভিগমন করে যে জন অর্ধেক পথ হতে প্রত্যাবৃত্ত হয়েছে, মহাসাগর সম্বন্ধে সে একরকম উত্তর দিবে; যে সমুদ্রতীরে পৌঁছেছিল, সে অন্য আরেক রকম উত্তর দিবে; আবার যে মধ্য-সমুদ্রে অবগাহন করেছিল, সে এসে আর এক প্রকার উত্তর দিবে। এরকম বিভিন্ন জনের নিকট বিভিন্ন প্রকার উত্তরই পাওয়া যাবে। তারপর, সে উত্তর যদি এক কথায় পাবার আকাঙ্ক্ষা কর, তাতে যে স্বরূপ-তত্ত্ব কতটুকু প্রকাশ পাবে, তা সহজেই বোধগম্য হয়। এই সকল কারণেই, এক কথায় উত্তর দিতে গিয়ে, পৃথিবীর পরম-পূজ্য বেদকে কেউ বা ‘চাষার গান’ বলে ঘোষণা করে গেছেন। এতই দুর্ভাগ্য আমাদের।

বেদ অধ্যয়নে অশেষ-জ্ঞান আবশ্যক-

বেদ বিষয়টি এতই জটিল, এতই গুরুতর যে, যতই সংক্ষেপে তার বিষয় আলোচনা করা যাক, যতই এক-কথায় তাকে বুঝার প্রয়াস পাওয়া যাক; বক্তব্য বিষয় স্বতঃই বিস্তৃত হয়ে পড়ে। আমরা প্রতিপন্ন করেছি, বেদ শব্দের অর্থ-জ্ঞান। বেদ কি-এক কথায় তার সংজ্ঞা প্রকাশ করতে গেলে, জ্ঞান ভিন্ন তাকে অন্য আর কি বলতে পারি? তবে সে জ্ঞান-কি জ্ঞান, কেমন জ্ঞান, সেটাই বিশেষ অনুধাবনের অনুভাবনার বিষয়। সে জ্ঞান লাভ করতে হলে-সে জ্ঞানে জ্ঞানী হবার আকাঙ্ক্ষা করলে বড় আয়াস- বড় প্রযন্ত প্রয়োজন। সে চেষ্টা- সে প্রযন্ত মানব-সাধারণের অধিগম্য নয়। তাই বেদ আলোচনায় বেদ অধ্যয়নে অশেষ প্রতিবন্ধক কল্পনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে; -স্ত্রী-শুদ্র-অব্রাহ্মণ বেদপাঠে অনধিকার। জ্ঞানরাজ্যে প্রবেশ করবার অধিকার সকলের আছে; স্বয়ং বেদই সে সাম্যবাদ ঘোষণা করছেন। সেই অনুসারে স্ত্রী-শুদ্র-অব্রাহ্মণ কারও বেদপাঠে অনধিকার নেই সত্য। কিন্তু তথাপি কেন, বেদ অধ্যয়নের পক্ষে নানা প্রতিবন্ধকতার প্রশ্রয় দেওয়া হয়? কেন’ই বা অধিকারী অনধিকারীর প্রসঙ্গ নিয়ে মস্তিষ্ক আন্দোলিত হয়ে থাকে? তার কারণ যথেষ্ট আছে। পাহাড়ের উপর আরোহণ করতে হলে প্রথমে পাহাড়ের নীচের দিকে উপস্থিত হতে হয়; পরে মধ্যভাগে, পরিশেষে শীর্ষদেশে উঠবার প্রয়াস প্রয়োজন হয়। কেউই একেবারে তুঙ্গশৃঙ্গ স্পর্শ করতে সমর্থ হন না। বেদরূপ জ্ঞান লাভ করতে হলেও তেমনি স্তরে স্তরে অগ্রসর হওয়ার আবশ্যক হয়। হঠাৎ একটি সূক্ত বা ঋক্‌ কন্ঠস্থ করতে পারলেই এবং সেই অংশের একটা যথেচ্ছ অর্থ স্থির করতে পারলেই যে বেদ অধ্যয়ন সম্পন্ন হয়, তা নয়। বেদ অধ্যয়ন করতে হলে, সর্ব প্রথমে বেদাঙ্গে অভিজ্ঞতা-লাভ প্রয়োজন। বেদ যে অনাদি অনন্তকাল হতে অভ্রান্ত প্রমাণ মধ্যে পরিগণিত হয়ে আসছে, আর যে উহা অক্ষত অপরিবর্ত্তিত ভাবে বিদ্যমান রয়েছে, বেদাঙ্গে অভিজ্ঞ হতে পারলে’ই তা বোধগম্য হতে পারে। অক্ষয় বেদাঙ্গ-সূত্র, অক্ষয় মণি-মালার ন্যায়, বৈদিক সূক্ত-সমূহকে গেঁথে রেখেছে। সুতরাং বেদাঙ্গ-তত্ত্ব আগে অনুশীলন করতে না পারলে বেদ-মধ্যে প্রবেশ করবে-সাধ্য কি?

ষড়বেদাঙ্গ-

বেদকে বুঝার জন্যই বেদাঙ্গের প্রবর্তনা। উহা ‘ষড়ঙ্গ’ নামে অবহিত হয়ে থাকে। শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দঃ ও জ্যোতিষ- এই ষড়ঙ্গের মধ্য দিয়েই নিগূঢ় বেদতত্ত্ব নিষ্কাষিত করতে হয়। এই ষড়ঙ্গ ভিন্ন বেদ-পাঠের সহায়তাকারী আরও কতগুলি পাঠ্য-গ্রন্থ আছে। পদ, ক্রম, জটা, ঘন প্রভৃতি বিষয়ক জ্ঞান সেই সকল গ্রন্থে লাভ করা যায়। তারপর আছে, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, উপনিষৎ, দর্শন, পুরাণ, উপপুরাণ। জ্ঞান-বুদ্ধির তারতম্য অনুসারে এদের এক একটির মধ্য দিয়ে বেদ-রূপ অনন্ত রন্তাকরের মধ্যে প্রবেশ করতে হয়। যাঁরা অল্প বুদ্ধি সম্পন্ন, যাঁরা সমুদ্রের তীরেও পৌঁছাতে পারে নি, তারা কি করে সে জ্ঞান-রত্নাকরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করার আশা করতে পারে? বেদ অধ্যয়ন করতে হলে অভিজ্ঞ হতে হবে-ষড়ঙ্গে। ষড়ঙ্গের প্রথম অঙ্গ-শিক্ষা। শিক্ষা-শিখাবে বর্ণ; শিক্ষা-শিখাবে স্বর; শিক্ষা-শিখাবে মাত্রা; শিক্ষা-শিখাবে বল; শিক্ষা-শিখাবে সাম। বর্ণ, স্বর, মাত্রা, বল ও সাম-শিক্ষা এই বিষয়ে-পাঁচ প্রকার শিক্ষা দেয়। যদি অকার আদি বর্ণের জ্ঞান না থাকে; যদি উদাত্তা আদি ত্রিবিধ স্বর অনুধাবন করতে অনভিজ্ঞ হও; হ্রস্ব মাত্রা, দীর্ঘ-মাত্রা প্রভৃতির জ্ঞান যদি না জন্মে; উচ্চারণ-স্থান আদির এবং সাম্য-গুণ আদির অভ্যাস যদি তুমি না করে থাক; বৃথাই তোমার বেদ অধ্যয়ন হবে। অ আ ক খ ইত্যাদি স্বর ও ব্যঞ্জন ভেদে বর্ণ দ্বিবিধ। শিক্ষা-গ্রন্থ এই বর্ণজ্ঞানের শিক্ষা দেয়। উদাত্ত, অনুদাত্ত, স্বরিৎ- স্বর এই ত্রিবিধ। উদাত্ত-উচ্চ স্বর; অনুদাত্ত-নীচ স্বর; স্বরিৎ-উভয় স্বরের মধ্যবর্তী স্বর। এই ত্রিবিধ স্বরের জ্ঞান না থাকলে, বেদমন্ত্র উচ্চারণ করতে গেলে, স্বর-বিকৃতি দোষ ঘটে। সে দোষে শুভ কামনায় মন্ত্র উচ্চারণে অশুভ ফল সঙ্ঘটিত হতে পারে। শাস্ত্রে এ বিষয়ে প্রশস্ত দৃষ্টান্তের উল্লেখ আছে। “ইন্দ্র শত্রুর্বর্দ্ধস্ব”- পাঠ-বিপর্য্যয়-হেতু এই মন্ত্র বিপরীত ফল প্রদান করেছিল। আদ্যোদাত্ত পাঠে এই মন্ত্রে এক ফল; আর অন্তোদাত্ত পাঠে এই মন্ত্রে আর এক ফল। প্রথমোত্ত পাঠে তৎপুরুষ সমাস বিধায়, অর্থ হয়-ইন্দ্রের শত্রুবৃদ্ধি হোক। আর শেষোক্ত পাঠে, আদ্যোদাত্ত হেতু, বহুব্রীহি সমাস বিধায় অর্থ হয়- ইন্দ্রের শত্রু বিনষ্ট হোক। উচ্চারণের বিভিন্নতা-হেতু এমনই অর্থ-বিপর্য্যয় ঘটে থাকে। এই জন্যই ঋক্‌-সমুহের উচ্চারণের উপযোগী চিহ্ন-স্বরলিপি-সমূহ-ব্যবহৃত হতে দেখি। এখনকার স্বর-বিজ্ঞানে স-ঋ-গ-ম-প-ধ-নি অর্থাৎ ষড়ঙ্গ, ঋষভ, গান্ধার, মধ্যম, পঞ্চম, ধৈবত, নিষাদ-এই সপ্ত স্বর প্রচলিত। অধুনা-প্রচলিত এই সপ্ত স্বর সেই বৈদিক স্বরত্রয় হতেই উদ্ভূত হয়েছে, প্রতিপন্ন হয়। উদাত্ত হতে নিষাদ ও গান্ধার, অনুদাত্ত হতে ঋষভ ও বৈধত, স্বরিৎ হতে ষড়ঙ্গ মধ্যম ও পঞ্চম স্বরের উৎপত্তি পরিকল্পিত হয়। উদাত্ত, অনুদাত্ত, স্বরিৎ-এই তিন প্রকার উচ্চারণ-ভেদ বুঝানোর জন্য বৈদিক গ্রন্থ-সমূহে অনেক স্থানে শব্দান্তর্গত বর্ণের উপরে ও নিন্মে বিবিধ রেখা চিহ্ন ব্যবহৃত হয়। সঙ্গীতের স্বরলিপিতে যে সকল চিহ্ন আদি প্রচলিত আছে, তাহা ঐ বৈদিক উচ্চারণ-মূলক রেখা-চিহ্নের অনুসৃতি বলেই মনে হয়। নিন্মে উদাহরণ ছলে ঋগ্বেদের আগ্নেয়-সূক্ত অন্তর্গত প্রথম ঋক্‌টি রেখাচিহ্ন অঙ্কিতরূপে যথাযথ উদ্ধৃত করেছি।

।           । ।            ।

ওঁ অগ্নিমিলে পুরোহিতং যজ্ঞস্য দেবমৃত্বিজং।

।           ।

হোতারং রন্তধাতমং ॥১॥

উদ্ধৃত ঋকের বর্ণ-বিশেষের শীর্ষদেশে যে লম্বমান রেখা অঙ্কিত হয়েছে, তার দ্বারা সে সে বর্ণের উদাত্ত স্বরে উচ্চারণ জানানো হয়েছে। আর, বর্ণবিশেষের নিন্মভাগে যে শায়িত রেখা দৃষ্ট হচ্ছে, তার দ্বারা সে সে বর্ণের অনুদাত্ত স্বরে উচ্চারণ বুঝাচ্ছে, যে যে বর্ণের নিন্মে কোনরকম রেখা অঙ্কন হয় নি, সে সে বর্ণের উচ্চারণ স্বরিৎ বলে বুঝতে হবে। সাধারণতঃ উচ্চারণ-প্রণালী এভাবে নির্দ্দিষ্ট হয়ে থাকে। এতদ্ভিন্ন, মাত্রা আদি বুঝানোর জন্য আরও নানারকম চিহ্ন ব্যবহৃত হয়। মাত্রা ত্রিবিধ;- হ্রস্ব, দীর্ঘ ও প্লুত। ‘কি’ হ্রস্ব, ‘কী’ দীর্ঘ, ‘কি-ই’ প্লুত। রোদনে গানে প্লুত-স্বর বিহিত হয়। উহাকে অতি-দীর্ঘ স্বর বলা যেতে পারে। ‘বল’ বলতে প্রযন্ত ও উচ্চারণ-স্থান বুঝায়। উচ্চারণ স্থান অষ্টবিধ;- কন্ঠ, তালু, মূর্দ্ধা ইত্যাদি। মতান্তরে উচ্চারণ-স্থান আরও অধিক পরিকল্পিত হয়ে থাকে। কিন্তু সেগুলিকে যৌগিক উচ্চারণ-স্থান বলা যেতে পারে। যেমন, কন্ঠ ও তালু হতে উচ্চারিত বর্ণ-কণ্ঠতালব্য ইত্যাদি নামে অভিহিত হয়। প্রযন্ত বলতে ‘চেষ্টা’ বুঝিয়ে থাকে। অল্প, অস্পৃষ্ট ভেদে প্রযন্ত বিবিধ। সাম অর্থাৎ সাম্য বলতে উচ্চারণ-সাম্য বুঝায়। অতি-দ্রুত, অতিশয়-দ্রুত প্রভৃতি দোষ রহিত এবং মাধুর্য গুণ-যুক্ত উচ্চারণ’ই সাম্য। ফলতঃ, যাতে সুস্বরে সকল ভাব ব্যক্ত হয়, উচ্চারণে কোনও বৈষম্য না ঘটে, তাকেই সাম্য বলে। শিক্ষা-গ্রন্থ এই সকল শিক্ষা প্রদান করে।

কল্প, ব্যাকরণ প্রভৃতি।

শিক্ষার পর কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত ও ছন্দ প্রভৃতির প্রসঙ্গ উত্থাপন করা যাচ্ছে। আপস্তম্ব, বৌধায়ন, আশ্বলায়ন প্রভৃতি ঋষিগণের প্রণীত সূত্র-সমূহ কল্প-গ্রন্থ নামে অভিহিত হয়। এতে যাগ-প্রয়োগ-বিধি কল্পিত আছে। এজন্যে এর নাম-কল্প-গ্রন্থ। কিরকম প্রণালী-তে যজ্ঞ আরম্ভ হবে, কোন‌ মন্ত্র কখন উচ্চারণ করতে হবে, যজ্ঞের কোন‌ কার্য্য, ঋত্বিক হোতা বা পুরোহিত, কে কি ভাবে সম্পন্ন করবেন;- কল্পসূত্রে তারই উপদেশ দেওয়া হয়েছে। বেদ-রূপ দেহের হস্ত-স্থানীয় বলেই কল্প-সূত্রের মাহাত্ম্য পরিকীর্ত্তিত হয়। ব্যাকরণ কে বেদের মুখ স্বরূপ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ব্যাকরণ ভিন্ন বেদের অভ্যন্তরে প্রবেশ করবে, সাধ্য কি? ব্যাকরণ ভিন্ন অর্থ-নিষ্কাষণ সম্ভপর নয়। অর্থ-জ্ঞান না হলে, বেদ অধ্যয়ন বৃথা, ক্রিয়াকর্ম পণ্ড। বেদের স্বরূপ জানতে হলে, বেদ কি তা বুঝতে হলে, ব্যাকরণ-জ্ঞান প্রথম প্রয়োজন। সে ব্যাকরণ আবার যে-সে ব্যাকরণ নয়। অধুনা-প্রচলিত ব্যাকরণের মধ্যে পাণিনি, মুগ্ধবোধ, কলাপ প্রভৃতি প্রসিদ্ধ। কিন্তু বৈদিক-সাহিত্যের পরিচয়ের জন্য বিভিন্ন ব্যাকরণ প্রবর্তিত ছিল। ‘প্রতিশাখা’(প্রতিশাখ্য) তাঁদের আদিভূত। প্রত্যেক বেদের প্রত্যেক শাখার ভিন্ন ভিন্ন প্রতিশাখা ছিল। সে সকল এখন বিলুপ্ত প্রায়। এখন মাত্র তিন বেদের তিনটি প্রতিশাখা পাওয়া যায়। ঋগ্বেদের প্রতিশাখা-মহামুনি সনক কর্তৃক প্রবর্তিত হয়েছিল। শুক্ল-যজুর্ব্বেদের প্রতিশাখা কাত্যায়ন প্রণয়ন করেন। কৃষ্ণ-যজুর্ব্বেদের একটি শাখা-প্রবর্ত্তকের মধ্যে বাল্মীকি নাম দেখতে পাই। উচ্চারণ, ছন্দঃ প্রভৃতির প্রসঙ্গ প্রতিশাখায় উত্থাপিত। প্রতিশাখাই প্রকারান্তর বৈদিক ব্যাকরণ। প্রতিশাখা সমূহের অনুসরণে পাণিনি, কাত্যায়ন, বাড়ি, গালব, ভাগুড়ী, পাতঞ্জল, বর্ষ প্রভৃতি বৈয়াকরণ ব্যাকরণ-রচনায় প্রসিদ্ধতা সম্পন্ন হন। তবে তাঁদের ব্যাকরণ অনুসারে পরবর্ত্তি বৈয়াকরণ ব্যাকরণ-রচনায় প্রসিদ্ধ সম্পন্ন হন। তবে তাঁদের ব্যাকরণ অনুসারে পরবর্ত্তি কালে যে ভাষা প্রবর্ত্তিত হয়, সে ভাষা বেদের ভাষা হতে স্বতন্ত্র হয়ে পড়ে। পাণিনি প্রভৃতির পূর্বেও বহু বৈদিক বৈয়াকরণ বিদ্যমান ছিলেন। তাঁদের মধ্যে অপিশালী, কাশ্যপ, গার্গ্যেয়, গালব, শত্রুবর্ম্মণ, ভারদ্বাজ, সাকল্য, সেনাকাশ, স্ফোটায়ন প্রভৃতির নাম অনুসন্ধান করে পাওয়া যায়। বলা হয়, তখন সন্ধি, সুবন্ত, তদ্ধিত প্রভৃতি শিক্ষার জন্য ভিন্ন ভিন্ন  গ্রন্থ অনুসন্ধান করতে হত। পাণিনি সেই সমস্ত বিষয় একত্রে সূত্র আকারে নিবদ্ধ করেন। বেদাঙ্গের অপর গ্রন্থের নাম-নিরুক্ত। বৈদিক শব্দের ও বৈদিক-বাক্য সমূহের অর্থ নিরুক্ত গ্রন্থে বিশদীকৃত হয়েছে। অর্থ-বোধের জন্য নিরুক্তকারদের মধ্যে যাস্ক ঋষিই অধুনা প্রসিদ্ধি-সম্পন্ন। স্থৌলাষ্ঠীবী, ঔর্ণবাভ, শাকপূণি প্রভৃতি প্রণীত নিরুক্ত গ্রন্থেরও উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। নিরুক্ত-গ্রন্থকে বেদের শ্রবণ ইন্দ্রিয় বলে পণ্ডিতগণ ঘোষণা করে থাকেন। নিরুক্তের পর ছন্দঃ গ্রন্থ। শিক্ষা বা স্বর-বিজ্ঞানের পর ছন্দঃ-জ্ঞানের উপযোগিতা অনুভূত হয়। ছন্দঃ- গ্রন্থের বীজ-বেদে, অঙ্কুরোদগম-আরণ্যকে, শাখা-প্রশাখা-উপনিষদে। ছন্দঃ-জ্ঞান ভিন্ন, রস-গুণ-দোষ উপলব্ধি হয় না; ছন্দঃ-জ্ঞান ভিন্ন উচ্চারিত শব্দ-সমূহ হৃদয়ে প্রবেশ করে না; তাই ছন্দের প্রাধান্য পরিকীর্ত্তিত হয়। বেদে প্রধানতঃ সাতটি ছন্দের উল্লেখ দেখতে পাই;- গায়ত্রী, উষ্ণিক, অনুষ্টুপ, বৃহতী, পংত্তি, ত্রিষ্টুভ, জগতী। সন্ধ্যাবন্দনায় ব্রাহ্মণ-মাত্রেই এই সকল ছন্দের পরিচয় পেয়ে থাকেন। চব্বিশ অক্ষরে(বা স্বরবর্ণে) তিন চরণে নিবদ্ধ যে ছন্দঃ, তাই গায়ত্রী। উষ্ণিক ছন্দে আটাশটি অক্ষর, অনুষ্টুপে বত্রিশটি, বৃহতীতে ছত্রিশটি, পংক্তিতে চল্লিশটি ছন্দঃ, ত্রিষ্টুভে চুয়াল্লিশটি এবং জগতীতে আটচল্লিশটি অক্ষর আছে। বেদ-ব্যবহৃত এই সাতটি ছন্দঃ ‘দৈবিক ছন্দঃ’ নামে অভিহিত। মহর্ষি কাত্যায়ন তাঁর ‘সর্ব্বানুক্রমনিকা’ গ্রন্থে এই সাতটি দৈবিক ছন্দের উল্লেখ করে গেছেন। পিঙ্গলাচার্য্য প্রভৃতি বিরচিত ছন্দঃ গ্রন্থ এককালে প্রসিদ্ধ সম্পন্ন ছিল। পিঙ্গলাচার্য্যের ছন্দঃ-গ্রন্থ-ছন্দঃ-মঞ্জরী-প্রাচীন ও প্রসিদ্ধ। পণ্ডিতগণ ঐ গ্রন্থকে বেদের পদস্বরূপ বলে কীর্ত্তন করেছেন। বেদ-ব্যবহৃত ছন্দের নাম-দৈবিক ছন্দঃ; আর বেদের পরবর্ত্তিকালে যে সকল ছন্দঃ বিরচিত হ্য়েছে, তার নাম-লৌকিক ছন্দঃ। মহর্ষি বাল্মীকি লৌকিক ছন্দের প্রবর্ত্তক বলে কথিত হন। ‘মা নিষাদ’ ইত্যাদি লৌকিক ছন্দের আদিভূত। তার পরে সংস্কৃত-সাহিত্যে অধুনা দুই শতাধিক ছন্দঃ প্রচলিত হয়েছে। তন্মধেও পঞ্চাশ প্রকার ছন্দঃ সাধারণতঃ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যাহোক, বেদ অধ্যয়নে ছন্দঃ প্রভৃতির জ্ঞান যে একান্ত আবশ্যক, তা বলাই বাহুল্য। ষষ্ঠ বেদাঙ্গ-জ্যোতিষ। যার দ্বারা সূর্য্য আদি গ্রহের অবস্থান বিষয়ে জ্ঞানলাভ হয়,-গ্রহ আদির গতি-স্থিতি প্রভৃতি বিষয়ে অভিজ্ঞতা জন্মে, তারই নাম-জ্যোতিষ শাস্ত্র। বেদবিহিত যজ্ঞ-কর্ম সম্পন্ন করতে হলে, জ্যোতিষ-শাস্ত্রের জ্ঞানলাভ বিশেষ প্রয়োজন। কোন সময়ে কোন কর্ম আরম্ভ করতে হবে, কোন্‌ সময়ে কোন্‌ কর্ম সমাপন করার আবশ্যক, জ্যোতিষ শাস্ত্র সেই জ্ঞান শিক্ষা দেয়। যথা নির্দিষ্ট সময়ে কর্ম আরম্ভ না হলে এবং যথা নির্দিষ্ট সময়ে কর্ম সমাপ্ত না হলে কর্ম পণ্ড হয়ে যায়। তাই জ্যোতিষের এত প্রয়োজন। পরাশর প্রভৃতি ঋষিগণ যজ্ঞের কালাকাল নির্ণয়ের জন্য জ্যোতিষের সূত্র রচনা করে গেছেন। পণ্ডিতগণ জ্যোতিষ শাস্ত্রকে বেদের চক্ষু-স্থানীয় বলে কীর্ত্তন করে থাকেন।  

পদ, ক্রম, জটা, ঘন প্রভৃতি।

পদ, ক্রম, জটা, ঘন প্রভৃতি আরও বহু জ্ঞাতব্য বিষয়ে বেদ অধ্যায়ীর অভিজ্ঞতা-লাভ আবশ্যক। মন্ত্রে সন্ধি-সূত্রে বহু পদ পরস্পর গ্রথিত আছে। সন্ধিসূত্র বিচ্ছিন্ন করে সেই সকল পদকে স্বতন্ত্র ভাবে বিন্যস্ত করাকে পদ, পদপাঠ বা পদবিশ্লেষণ বলে। পদবিশ্লেষণ ভিন্ন, কোন্‌ শব্দ কিভাবে অবস্থিত আছে,- সে জ্ঞান লাভ ব্যতীত, কেমন করে বেদের মধ্যে প্রবেশ করতে সমর্থ হবে? আগ্নেয়-সূক্তের যে প্রথম ঋক্‌, তারই প্রসঙ্গ উত্থাপন করছি। স্বর-প্রসঙ্গ ঋক্‌টি উদ্ধৃত করছি। পদ-বিশ্লেষণ করলে, তা নিম্নরূপে বিন্যস্ত করা যেতে পারে। যথা,-

।           ।         ।

ওঁ অগ্নি। ঈলে। পুরঃহহিতং। যজ্ঞস্য। দেবং। ঋত্বিজং।

।               ।

হোতারং। রত্নহধাতমং ॥১॥

সন্ধি-বিচ্ছেদের পর কোন পদ কেমন ভাবে অবস্থিত ও উচ্চারিত হয়, উক্ত দৃষ্টান্তে তা বোধগম্য হবে। ক্রম, জটা ও ঘন বিষয়ে প্রসিদ্ধ বেদ-ব্যাখ্যাতা রমানাথ সরস্বতী কৃত ঋগ্বেদ গ্রন্থের  অনুক্রমণিকা অংশ সংক্ষপে যা লিখেছেন, নিন্মে সেই অংশ উদ্ধৃত করা গেল। যথা-

ক্রম। -কোন্‌ পদের পর কোন পদ উচ্চারণ করতে হবে এবং কোন্‌ মন্ত্রের কোন্‌ পদ শেষ হলে কোন্‌ মন্ত্রের কোন্‌ পদ উচ্চারিত হবে, তা ক্রম-গ্রন্থে নিরুপন হয়েছে। ক্রম-পাঠ বহুবিধ;-পদক্রম, বর্ণক্রম প্রভৃতি। যথা, ঋগ্বেদের প্রথম মন্ত্র- ‘অগ্নিমীলে পুরোহিতং যজ্ঞস্য যজ্ঞস্য দেবং দেবং ঋত্বিজং’ ক্রম অনুসারে পাঠ করতে হলে ‘অগ্নি ঈলে ঈলে পুরোহিতং পুরোহিতং যজ্ঞস্য যজ্ঞস্য দেবং দেবং ঋত্বিজং’ ইত্যাদি পদক্রম এবং ‘অগ্নি গ্নিমী মীলে লেপু পুরো রোহি’ ইত্যাদি বর্ণক্রম।

জটা।-জটাপাঠ ক্রমপাঠ অপেক্ষাও কৃত্রিম এবং যত্নে রচিত। যথা,- পূর্বে উদ্ধৃত ঋগ্বেদের প্রথম মন্ত্র ‘অগ্নিং ঈলে ঈলে অগ্নিং অগ্নিং ঈলে ঈলে পুরোহিতং পুরোহিতং ঈলে ঈলে পুরোহিতং ঈলে ঈলে পুরোহিতং পুরোহিতং যজ্ঞস্য যজ্ঞস্য পুরোহিতং পুরোহিতং যজ্ঞস্য ইত্যাদি।’ প্রত্যেক পদদ্বয়ের তিন বার আবৃত্তি করতে হবে এবং দ্বিতীয় বার আবৃত্তির সময় দ্বিতীয় পদটি প্রথমে ও প্রথম পদটি তার পরে পাঠ করতে হবে।

ঘন। পূর্ব্বোক্ত অনুরূপ আর এক প্রকার বৈদিক মন্ত্রের পাঠ আছে, তাকে ঘনপাঠ বলে। ‘অগ্নিং ঈলে, ঈলে অগ্নিং, অগ্নিং ঈলে পুরোহিতং পুরোহিতং ঈলে অগ্নিং অগ্নিং ঈলে পুরোহিতং। ১) ঈলে পুরোহিতং, পুরোহিতং ঈলে, ঈলে পুরোহিতং যজ্ঞস্য পুরোহিতং ঈলে, ঈলে পুরোহিতং যজ্ঞস্য। ২) পুরোহিতং যজ্ঞস্য, ইত্যাদি প্রত্যেক পদ হতে এক একটি ঘনপাঠ হয়। এতদ্ভিন্ন অন্য নানা প্রকার পাঠের নিয়ম থাকতে পারে। ইত্যাদি কারণ বশতঃ বেদের পাঠভেদ দূরে থাকুক, অক্ষর-মাত্রেরও ব্যতিক্রম ঘটার সম্ভাবনা নেই।

বেদ পাঠ করার কি কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম আছে? Are there any specific rules for reciting the Vedas?

 

Are there any specific rules for reciting the Vedas?

হ্যাঁ, বেদের আবৃত্তি, যা প্রাচীন হিন্দু ধর্মগ্রন্থ, নির্দিষ্ট নিয়ম ও নির্দেশিকা অনুসরণ করে। এই নিয়মগুলি "বৈদিক জপ" বা "বেদ আবৃত্তি" নামে পরিচিত এবং বৈদিক পণ্ডিতদের প্রজন্মের মধ্য দিয়ে চলে এসেছে। এখানে বেদ পাঠের নিয়মের কিছু মূল দিক রয়েছে:


উচ্চারণ: বেদ পাঠে সঠিক উচ্চারণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বৈদিক গ্রন্থের ধ্বনি এবং উচ্চারণ অবশ্যই সুনির্দিষ্টভাবে উচ্চারণ করতে হবে, কারণ সামান্য ভুল উচ্চারণও আয়াতের অর্থ পরিবর্তন করতে পারে। প্রতিটি শব্দাংশ এবং স্বরবর্ণের সঠিক উচ্চারণে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া হয়।


পিচ এবং মড্যুলেশন: বৈদিক আবৃত্তিতে "স্বরা" নামে পরিচিত একটি নির্দিষ্ট পিচ এবং মডুলেশন প্যাটার্ন জড়িত। প্রতিটি শব্দাংশ একটি নির্দিষ্ট স্বর দিয়ে উচ্চারণ করা হয়, যা আবৃত্তিকে একটি সুরেলা এবং ছন্দময় গুণ দেয়। পিচ বৈচিত্র্য বৈদিক শ্লোকগুলির সূক্ষ্মতা এবং সূক্ষ্মতা জানাতে সাহায্য করে।


উচ্চারণ: বৈদিক মন্ত্রগুলি "উদত্ত, অনুদত্ত এবং স্বরিতা" নামক একটি নির্দিষ্ট স্বর বিন্যাসের সাথে আবৃত্তি করা হয়। এগুলি যথাক্রমে উচ্চ, নিম্ন এবং মধ্য টোন নির্দেশ করে। এই সুরের সংমিশ্রণ আবৃত্তিকে এক অনন্য সঙ্গীতময়তা দেয়।


বিরতি এবং উচ্চারণ: বেদে বিরতি এবং উচ্চারণের জন্য নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। সেখানে নির্দিষ্ট পয়েন্ট আছে যেখানে বিরতি প্রয়োজন, এবং সিলেবলের সঠিক উচ্চারণের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। এই বিরতি এবং উচ্চারণের মাধ্যমে আবৃত্তির ছন্দ ও প্রবাহ বজায় থাকে।


প্রশিক্ষণ এবং মুখস্থ করা: বৈদিক আবৃত্তি ঐতিহ্যগতভাবে মৌখিক ঐতিহ্যের মাধ্যমে চলে আসে। সঠিক উচ্চারণ, পিচ এবং স্বর শেখার জন্য শিক্ষার্থীরা অভিজ্ঞ শিক্ষকদের নির্দেশনায় কঠোর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। আবৃত্তিটি প্রতিটি শব্দাংশের সুনির্দিষ্ট উচ্চারণ এবং মিটার সহ শব্দের জন্য শব্দ মুখস্ত করা হয়।


আচারিক বিশুদ্ধতা: বেদ পাঠ প্রায়ই ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং আচার-অনুষ্ঠানে সম্পাদিত হয়। তাই আবৃত্তিকারের জন্য আচারের পবিত্রতা গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে রয়েছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা পর্যবেক্ষণ করা, মনের একটি সঠিক অবস্থা বজায় রাখা এবং আবৃত্তিতে জড়িত হওয়ার আগে ঐতিহ্যগত শুদ্ধিকরণ আচারগুলি অনুসরণ করা।


এটি লক্ষ করা গুরুত্বপূর্ণ যে বৈদিক জপ একটি বিশেষ দক্ষতা যার জন্য নিবেদিত অধ্যয়ন এবং প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। বৈদিক পণ্ডিতরা প্রাচীন গ্রন্থগুলির সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে এবং তাদের অর্থ ও শব্দের অখণ্ডতা বজায় রাখতে বৈদিক পাঠের জটিলতাগুলি আয়ত্ত করতে বছরের পর বছর ব্যয় করেন।


Yes, the recitation of the Vedas, which are ancient Hindu scriptures, follows specific rules and guidelines. These rules are known as "Vedic Chanting" or "Vedic Recitation" and have been passed down through generations of Vedic scholars. Here are some key aspects of the rules for reciting the Vedas:

  1. Pronunciation: Correct pronunciation is crucial in Vedic recitation. The sounds and accents of the Vedic texts must be pronounced precisely, as even a slight mispronunciation can change the meaning of the verses. Special attention is given to the correct enunciation of each syllable and vowel.

  2. Pitch and Modulation: Vedic recitation involves a specific pitch and modulation pattern known as "svara." Each syllable is chanted with a particular svara, which gives the recitation a melodic and rhythmic quality. The pitch variations help in conveying the nuances and subtleties of the Vedic verses.

  3. Intonation: Vedic chants are recited with a particular intonation pattern called "udatta, anudatta, and svarita." These indicate the high, low, and middle tones respectively. The combination of these tones gives a unique musicality to the recitation.

  4. Pauses and Articulation: The Vedas have specific rules for pauses and articulation. There are designated points where pauses are required, and proper articulation of the syllables is emphasized. The rhythm and flow of the recitation are maintained through these pauses and articulations.

  5. Training and Memorization: Vedic recitation is traditionally passed down through oral tradition. Students undergo rigorous training under the guidance of experienced teachers to learn the correct pronunciation, pitch, and intonation. The recitation is memorized word-for-word, including the precise pronunciation and meter of each syllable.

  6. Ritual Purity: Vedic recitation is often performed in religious ceremonies and rituals. Therefore, ritual purity is important for the reciter. This includes observing cleanliness, maintaining a proper state of mind, and following traditional purification rituals before engaging in recitation.

It's important to note that Vedic chanting is a specialized skill that requires dedicated study and training. Vedic scholars spend years mastering the intricacies of Vedic recitation to ensure the preservation of the ancient texts and maintain the integrity of their meaning and sound.

বাণী চিরন্তণী Motivational quotes

Popular Posts

Hindu international Consciousness

ad

Featured Post

পবিত্র বেদ পাঠ,পবিত্র বেদ পাঠ বিভাগ – ॐ সনাতন ধর্মতত্ত্ব পবিত্র বেদের উৎপত্তি ও ইতিহাস

বেদ মাতার ইচ্ছায় বাংলা ভাষায় ঋগ্বেদের মূলমন্ত্র অর্থ ও টীকাসহ প্রকাশের চেষ্টা করা হয়েছে। ধীরে ধীরে এর কলেবর বৃদ্ধি করার চেষ্টা চলতে থাক...