বেদ বিষয়ে দর্শন-শাস্ত্র।
[বেদ বিষয়ক বিতর্ক দর্শন শাস্ত্রে; -শব্দের নিত্যত্ব বিষয়ে নৈয়ায়িকদের আপত্তি;- মীমাংসক কর্ত্তৃক সেই আপত্তির খণ্ডন;- মীমাংসাদর্শনে বেদের নিত্যত্ব বিষয়ে যুক্তি; -বেদের প্রামাণ্য-বিষয়ে গৌতমের পূর্বপক্ষ রূপে বিতর্ক ও উত্তরপক্ষ রূপে উত্তর; -বেদের প্রামাণ্য বিষয়ে পূর্বপক্ষ রূপে অপরাপর বিতর্ক এবং উত্তরপক্ষ রূপে তার উত্তর; বেদের অপৌরুষত্ব সম্বন্ধে বিতর্ক ও মীমাংসা;- বেদ বিষয়ে সাংখ্য, বৈশেষিক ও বেদান্ত আদির মত।]
বেদ বিষয়ক বিতর্ক
সকল শাস্ত্রেই বেদ বিষয়ে আলোচনা দেখা যায়। বেদ যে নিত্য, বেদ যে অপৌরুষেয়, বেদ যে অনাদি, এ সম্বন্ধে বিচার-বিতর্কের অবধি নেই। ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, উপনিষৎ, দর্শন, পুরাণ-সর্বত্রই বেদ-বিষয়ক আলোচনা আছে। সে সম্বন্ধে দর্শন-শাস্ত্রের বিচার ও মীমাংসা, জ্ঞানার্থি মাত্রই কৌতুহল উদ্দীপক। সুতরাং অন্যান্য শাস্ত্রে বেদের বিষয় কিভাবে আলোচিত হয়েছে, তা উল্লেখের পূর্বে, বেদ বিষয়ে দর্শন শাস্ত্রের গবেষণার আভাষ তুলে ধরা গেল। বিচারে পূর্বপক্ষ ও উত্তরপক্ষ রূপে বেদ প্রতিবাদ দ্বারা মীমাংসা হয়ে থাকে। এক সম্প্রদায়ের দার্শনিকেরা বেদের অপৌরুষেয়ত্ব বা নিত্যত্ব স্বীকার করেন না; এবং সেই পক্ষেই যুক্তিজাল বিস্তার করে থাকেন। অপর সম্প্রদায়ের দার্শনিকেরা প্রথমোক্ত সপ্রদায়ের যুক্তি-পরম্পরাকে পূর্বপক্ষরূপে পরিগ্রহণ করে, উত্তরপক্ষ রূপে তার উত্তর দিয়ে গেছেন। এ সম্বন্ধে নৈয়ায়িকদের ও মীমাংসকদের বিচার-প্রণালী বিশেষভাবে প্রণিধানের বিষয়।
১। বেদ নিত্য কি না-তার বিষয়ে বিতর্ক ও মীমাংসা। শব্দের নিত্যত্ব বিষয়ে আপত্তি।
নৈয়ায়িকরা বলেন, ‘শব্দ কখনও নিত্য হতে পারে না। বেদ যখন শব্দসমষ্টি, তখন এর নিত্যত্বে বিঘ্ন ঘটছে। এই সম্বন্ধে নৈয়ায়িকদের ছয়টি প্রসিদ্ধ সূত্র দেখতে পাওয়া যায়। প্রথম,-“কর্ম্ম একে তত্র দর্শনাৎ।” অর্থাৎ, যত্নদ্বারা শব্দ উচ্চারিত হয়। যা চেষ্টা সাপেক্ষ, তাই কর্ম। কর্ম ধ্বংসশীল, সুতরাং শব্দও অনিত্য। দ্বিতীয়, “অস্থানাৎ” অর্থাৎ, উৎপত্তি মাত্র শব্দ নষ্ট হয়; শব্দ অস্থায়ী; সুতরাং শব্দে নিত্যত্ব সম্ভব নয়। তৃতীয়,- “করোতি শব্দাৎ” অর্থাৎ, শব্দ করে থাকে অর্থাৎ লোকে শব্দের সৃষ্টিকর্ত্তা। যা করা হয়(লোকে তৈরি করে), তা কখনই নিত্য হতে পারে না। চতুর্থ,- “সত্ত্বান্তরে যৌগপদ্যাৎ” অর্থাৎ, শব্দ একই সময় নিকটস্থ এবং দূরস্থ বহু ব্যক্তি শুনতে পায়। সুতরাং শব্দ এক ও নিত্য হতে পারে না। পঞ্চম,- “প্রকৃতিবিকৃত্যোশ্চ” অর্থাৎ, প্রকৃতি প্রত্যয় হেতু শব্দ রূপান্তরিত হয়ে থাকে; যার রূপান্তর বা বিকৃতি ঘটে, তাকে কখনই নিত্য বলা যেতে পারে না। ষষ্ঠ,- “বৃদ্ধিশ্চ কর্ত্তৃভূম্নাস্য” অর্থাৎ, একই শব্দ একাধিক ব্যক্তি উচ্চারণ করলে, একাধিক বার সেই শব্দ উচ্চারিত হতে পারে। শব্দকর্ত্তার সংখ্যার হ্রাস-বৃদ্ধি হেতু শব্দেরও হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে থাকে। যা হ্রাসবৃদ্ধিশীল, তা নিত্য হতে পারে না। এরূপে নৈয়ায়িকেরা বেদের নিত্যত্ব-বিষয়ে প্রতিবাদ উত্থাপন করে থাকেন।
পূর্ব্বোক্ত আপত্তির খণ্ডন-
মীমাংসকগণ ঐরূপ আপত্তির খণ্ডন করে গেছেন। পূর্বপক্ষরূপে ঐ সকল আপত্তি উত্থাপন করে, মীমাংসা দর্শনের নিন্মলিখিত সূত্র পঞ্চকে তাদের নিরসন করা হয়েছে।
প্রথমে,- “স্বতঃ পরমদর্শনং বিষয়ানাগমাৎ” অর্থাৎ, শব্দ উচ্চারিত হলেও শব্দকারীর সাথে এর সম্বন্ধ থাকে না। পরন্তু যে শব্দে যে জ্ঞান, তা সমভাবেই বিদ্যমান থাকে। সুতরাং শব্দ অনিত্য নয়, নিত্য। ‘রাম’ এই শব্দ শ্রুতিগোচর হলে, ঐ শব্দের একটি জ্ঞান থেকে যায়; পূর্বে ঐ শব্দ যেমন শুনেছি, তার সাথে এর অভিন্নতা সূচিত হয়। সুতরাং, শব্দের নিত্য ও একত্ব অনুভবসিদ্ধ। দ্বিতীয়,-“প্রয়োগস্য পরমং” অর্থাৎ ‘শব্দ করে’ এর তাৎপর্য্য- শব্দের নির্মাণ নয়, শব্দের উচ্চারণ মাত্র। তৃতীয়,-“আদিত্যবৎ যৌগপদ্যং” অর্থাৎ সূর্য্য যেমন নিকটস্থ ও দূরস্থ সকল ব্যক্তির পরিদৃশ্যমান, অথচ তিনি যেমন এক ভিন্ন দ্বিতীয় নহেন, শব্দও সেরূপ বহু ব্যক্তির কর্ণে ধ্বনিত হলেও এক ভিন্ন দ্বিতীয় হয় না। চতুর্থ,- “বর্ণান্তরমবিকারঃ” অর্থাৎ প্রকৃতি প্রত্যয় সহযোগে বর্ণের পরিবর্ত্তনে বর্ণের বিকার হয় না; বর্ণান্তরে বর্ণের অবস্থিতি ঘটে মাত্র। যেমন, ‘ই’ কার স্থানে ‘য’ কার হলে, বর্ণান্তর আদেশ হয় বটে; কিন্তু ‘ই’ কারের কোনও অসদ্ভাব ঘটে না। পঞ্চম,- “নাদবৃদ্ধিঃ পরা” অর্থাৎ, একই শব্দ বহুবার উচ্চারিত হলে ধ্বনি মাত্র বৃদ্ধি হয়; শব্দ বা শব্দ কথিত বস্তুর বৃদ্ধি ঘটে না। পুনঃ পুনঃ গো-শব্দ উচ্চারিত হলে, নাদ বা কোলাহল বৃদ্ধি হয় বটে; কিন্তু বস্তুপক্ষে কোনরূপ সংখ্যাধিক্য হয় না। সুতরাং শব্দের নিত্যত্ব অবিসম্বাদিত।
পূর্ব্বোক্ত বিষয়ে অন্যান্য যুক্তি-
মীমাংসা দর্শন শব্দের নিত্যত্ব প্রমাণের জন্য আরও কতগুলি যুক্তি নির্দ্দেশ করেছেন। তারই পাঁচটি যুক্তি এখানে তুলে ধরা হল।
প্রথম- “নিত্যস্তু স্যাৎ দর্শনস্য পরার্থত্বাৎ” অর্থাৎ, যখন উচ্চারণ মাত্র শব্দের অর্থ পরিগ্রহ হয়, শব্দ বিনষ্ট হয় না, তখন শব্দকে নিত্য বলাই সঙ্গত। শব্দ যদি নিত্য না হোত, শব্দের যদি অর্থবোধ কেউ না করতে পারত, তাহলে শব্দ উচ্চারণ মাত্রেই ধ্বংসপ্রাপ্ত সুতরাং অনিত্য বলে অভিহিত হতে পারত। শব্দের স্থিতি মানলেই নিত্যত্ব স্বীকার করতে হয়। দ্বিতীয়- “সর্বত্র যৌগপদ্যাৎ” অর্থাৎ, ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি শব্দের একরকম অর্থ পরিগ্রহ করতে পারেন; সমভাবে অভ্রান্তরূপে ভিন্ন ভিন্ন জনের অর্থবোধ ঘটে; এই জন্যই শব্দ নিত্য ও এক। তৃতীয়,- “সংখ্যাভাবাৎ” অর্থাৎ, শব্দের ক্ষয় বৃদ্ধি নেই। বার বার উচ্চারণ হলেও শব্দ একই থাকে। চতুর্থ- “অনপেক্ষত্বাৎ” অর্থাৎ, শব্দ বিনষ্ট হওয়ার কোনও হেতুবাদ দেখা যায় না। সুতরাং শব্দ অনিত্য নয়-নিত্য। পঞ্চম- “লিঙ্গদর্শনাচ্চ” বেদ আদি শাস্ত্রে শব্দকে নিত্য বলে চিহ্নিত করা হয়েছে বলে, শব্দের নিত্যত্ব স্বীকার করতে হয়। শ্রুতি যাকে নিত্য বলে ঘোষণা করেছেন, শাস্ত্র যার নিত্যত্ব অঙ্গীকার করেন, তাই নিত্য। সুতরাং শব্দ মূলাধার ‘বেদ’ নিত্য বলে সপ্রমাণ হয়। শব্দের নিত্যত্ব সম্বন্ধে আরও বিবিধ বিতর্ক উত্থিত হয়। বেদে “ববরঃ প্রাবাহণিরকাময়ত” ইত্যাদি মন্ত্র আছে। কেউ কেউ এর অর্থ এভাবে নিষ্পন্ন করেন যে, ববর নামক কোনও মনুষ্য প্রাবাহণি বায়ুকে কামনা করেছিল। এমন অর্থের ফলে, সেই অনিত্য ববরের পরবর্ত্তী কালে বেদমন্ত্র রচিত হয়েছিল, প্রতিবাদকারী এরূপ প্রতিপন্ন করেন। তাহলে, বেদের নিত্যত্ব স্বতঃই অপ্রমাণিত হচ্ছে। কিন্তু মীমাংসকগণ এ সংশয়ের নিরসন করে গেছেন। অনিত্য দর্শনরূপ উক্ত আশঙ্কার উত্তরে তাঁরা সূত্র করে গেছেন, “পরন্তু শ্রুতিসামান্যমাত্রম”; অর্থাৎ, ববর আদি শব্দ দ্বারা কোনও মনুষ্যকে বুঝায় না, পরন্তু উহা ধ্বনিমাত্র; অর্থাৎ, ববর ধ্বনি বিশিষ্ট প্রবহমাণ বায়ুকে ঐস্থানে লক্ষ্য করা হয়েছে। বায়ুপ্রবাহের অনিত্যত্ব কে প্রচার করবে? সুতরাং এসকল সংশয়-প্রশ্নেও বিঘ্ন ঘটতে পারে না। বেদের নিত্য অনিত্য প্রশ্ন মীমাংসা প্রসঙ্গে আর একটি গুরুতর তর্ক উঠে থাকে। বেদে ইন্দ্র মরুৎ আদিত্য রুদ্র প্রভৃতির নাম দেখা যায়। কারও উৎপত্তি না হলে তার নাম হবে কি প্রকারে? মনে করুন, দেবদত্তের পুত্রের নাম যজ্ঞদত্ত; পুত্রের উৎপত্তি হয়েছিল বলেই তার নামকরণ হয়। সুতরাং ইন্দ্র আদি দেবগণের উৎপত্তি স্বীকার করতে হয়। উৎপত্তি স্বীকার করলে, অনিত্যত্ব অস্বীকার করা যায় না। এই সকল অনিত্য দেবাদির নাম যখন বেদে দেখা যায়, তখন বেদ কেন না অনিত্য হবে? এই প্রশ্নের উত্তরে মীমাংসকেরা বলেন, নিত্য ও অনিত্য দুই ভাবেই দেবগণের অধিষ্ঠান সপ্রমাণ হয়। তাঁরা যখন দেহধারণ করেন, তখন তাঁদের কে অনিত্য বলতে পারি। যা আকৃতি অবয়ব বিশিষ্ট, তা অবশ্যই বিনাশশীল। কিন্তু যখন ইন্দ্র আদি দেব-বিষয়ক স্মৃতি বা জ্ঞানে প্রকাশ পায়, তখন তার নিত্যত্ব স্বীকার করতে হয়। পদার্থ ও পদার্থ বিষয়ক জ্ঞানে স্বাতন্ত্র্য আছে। পদার্থ ধ্বংসশীল; কিন্তু তদ্বিষয়ক জ্ঞান অবিনাশী-নিত্য। ‘রাম’ বলে সম্বোধন করলাম; এটা ব্যক্তিবিশেষকে বুঝাল; রাম নামধারী কোনও ব্যক্তি সামনে আসলেন। সে ব্যক্তি নশ্বর, সে ব্যক্তি ধ্বংসশীল। কিন্তু সেই ‘রাম’ ধ্বংস হওয়ার পূর্বে ও পরে, তাঁর বিষয়ে একটি জ্ঞান আমাদের হৃদয়ে বদ্ধমূল থাকে। সে জ্ঞান তিনি যেমন রূপবান গুণবান বুদ্ধিমান ছিলেন, তাঁর কেমন আকৃতি প্রকৃতি ছিল ইত্যাদি। ব্যক্তি ‘রাম’ ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও তাঁর সম্বন্ধে সেই সে জ্ঞান, তা ধ্বংস হয় না। এই হিসাবে রাম ধ্বংস প্রাপ্ত হলেও রাম নাম অবিনাশী নিত্য। বেদে যে ইন্দ্র আদি দেবতার নাম উল্লেখ দেখতে পাই, তা ইন্দ্র আদি দেব-বিষয়ক জ্ঞান। সুতরাং তা নিত্য হবে না কেন? অতএব বেদের নিত্যত্ব অবিসংবাদিত।
২। বেদের প্রামাণ্য বিষয়ে বিতর্ক ও মীমাংসা।
বেদ বাক্যের প্রামাণ্য বিষয়ে দর্শন রচনাকারদের মস্তিষ্ক নানাভাবে আলোড়িত হয়েছে। মহর্ষি গৌতম ন্যায়-দর্শনে পূর্বপক্ষ ও উত্তরপক্ষ রূপে সে সন্দেহের নিরসন করে গেছেন। গৌতম সূত্রে পূর্বপক্ষ রূপে বেদের প্রামাণ্য বিষয়ে সন্দেহ উপস্থাপন করা হয়েছে,- “তদপ্রামাণ্যমনৃতব্যাঘাত পুনরুক্তদোষেভ্যঃ।” অর্থাৎ, বেদ যে অপ্রমাণ, তার কারণ, উহাতে অসত্য অর্থাৎ মিথ্যাবাদ, ব্যাঘাত এবং পুনরুক্তি দোষ আছে। বেদবাক্য যে অসত্য, তার নিদর্শন-স্বরূপ টীকাকারেরা বলেন যে, বেদে লেখা আছে, পুত্রেষ্টি যাগ করলে পুত্রসন্তান লাভ হবে; কিন্তু কার্য্যতঃ সর্বত্র তার সাফল্য দেখা যায় না; সুতরাং বেদবাক্য মিথ্যা বলে প্রতিপন্ন হয়। বেদ বাক্য যে ব্যাঘ্যাতমূলক, তার দৃষ্টান্তস্থানে উল্লেখ করা হয় যে, বেদের কোথাও বলা আছে- উদয় কালে হোম করবে, কোথাও বলা হয়েছে,- অনুদয় কালে হোম করবে; এবং তাতে এক কালের প্রসঙ্গে অন্যকালের নিন্দাও দেখতে পাওয়া যায়। সুতরাং ব্যাঘাত দোষ ঘটছে। এমন আরও দেখা যায়, পরব্রহ্ম সম্বন্ধে ও শ্রুতিবাক্যের ঐক্য নেই। শ্রুতিতেও কোথাও আছে,- “একমেবাদ্বিতীয়ং ব্রহ্ম”, আবার কোথাও আছে, “দ্বে ব্রহ্মণী বেদিতব্যে পরঞ্চাপমেব চ।” অর্থাৎ, একটিতে অদ্বৈতবাদ, অপরটিতে দ্বৈতবাদ বিঘোষিত হয়েছে। পুনরুক্তির তো কথাই নেই। একই কথা বেদে পুনঃ পুনঃ উক্ত হয়েছে। এভাবে পূর্ব্বপক্ষ ঘোষণা করে, মহর্ষি গৌতম নিজেই তা খণ্ডন করেছেন। বেদবাক্য যে মিথ্যা নয়, তারসম্বন্ধে তিনি বলছেন,- “ন কর্ম্মকর্ত্তৃসাধনবৈগুণ্যাৎ।” তাঁর মতে, তিনটি কারণে বৈদিক কর্মে ফল লাভ হয় না। প্রথমতঃ কর্মকর্তা অনধিকারী; দ্বিতীয়ত, মন্ত্রের উচ্চারণে দোষ; তৃতীয়তঃ, বিধিবিহিত কর্ম অনুষ্ঠান। এই তিনটিই অভীষ্ট ফলে অন্তরায়-সাধক। উপযুক্ত কর্ম না করলে ফলের আশা কিভাবে করা যেতে পারে? সুতরাং বেদবাক্য মিথ্যা নয়; কর্মকারীর কর্মদোষেই কর্ম অনুষ্ঠান পণ্ড হয়ে থাকে। কালাকাল ঘটিত ব্যাঘাত দোষ বিষয়ে গৌতমের উত্তর,- উদয় ও অনুদয় উভয় কালই হোম আদির পক্ষে প্রশস্ত বটে; কিন্তু এককালে সঙ্কল্প করে, অন্যকালে কর্তব্য করলে অভীষ্ট লাভে বিঘ্ন ঘটতে পারে। মন্ত্রের এটাই উদ্দেশ্য। ব্রহ্ম সম্পর্কেও ‘তিনি এক’ ‘তিনি দুই’ এই যে অদ্বৈত ও দ্বৈতবাদ দেখা যায়, তারও কারণ, -জীবের জ্ঞান বৈগুণ্য। জীবের যখন অজ্ঞান অবস্থা, জীব যখন আত্মা-পরমাত্মার অভেদভাব বুঝতে পারে না; তখন আপনাকে ও ব্রহ্মকে দুই বলে মনে করে। যখন তার তত্ত্ব-জ্ঞান উপস্থিত হয়, সে তখন সর্ব্বত্রই ব্রহ্ম ভাব উপলব্ধি করে। জীবের সেই অবস্থাদ্বয় বুঝানোর জন্যই দ্বৈতাদ্বৈতবাদ প্রসঙ্গ।
বেদের প্রামাণিক বিষয়ে এতে ব্যাঘাত ঘটার কি আছে? পুনরুক্তি সম্বন্ধে গৌতম বলেছেন- প্রয়োজন বুঝানোর জন্য যে বাক্য বার বার উচ্চারিত হয়, তা কদাচ পুনরুক্তি দোষ মধ্যে গণ্য হতে পারে না। পাছে ভ্রান্তি বশে জীব কর্তব্য ভ্রষ্ট হয়, তাই তাকে উদ্বোধিত করার জন্য বেদে কোনও কোনও বিষয় একাধিকবার উল্লেখ করা হয়েছে। উহা জীবের মঙ্গলার্থ-প্রযুক্ত, সুতরাং উহা পুনরুক্তি-দোষ-দুষ্ট নয়। যা আবশ্যক বা যা একান্ত করণীয়, সে সম্বন্ধে একাধিক বার উপদেশ দেওয়া হলে, সে উপদেশ হৃদয়ে বদ্ধমূল হতে পারে এবং তার দ্বারা সফলতা আনয়ন করে। সেই উদ্দেশ্যেই এক এক উপদেশ বার বার প্রদত্ত হয়েছে। তাকে দোষ বলা যায় না।
বেদের প্রামাণ্য ও নিত্যত্ব বিষয়ে-
অসত্য, ব্যাঘাত, পুনরুক্তি-ত্রিবিধ দোষ খণ্ডন করে গৌতম নিজমত স্থাপন করেছেন। তিনি বলেছেন- “মন্ত্রায়ুর্ব্বেদবৎ চ তৎপ্রামাণ্যং আপ্তপ্রাম্যাণ্যাৎ।” অর্থাৎ, প্রণেতার উপদেশ যথার্থ বলেই আয়ুর্ব্বেদ-শাস্ত্র প্রমাণ মধ্যে গণ্য হয়। তেমনি বেদকর্তা যথার্থবাদী বলে বেদের বাক্য প্রামাণ্য বলতে হয়। এ বিষয়ে বৃত্তিকারের উক্তি পাঠ করলে, বিষয়টি পরিস্কার হতে পারে।
“আপ্তস্য বেদকর্ত্তুঃ প্রামাণ্যাৎ যথার্থোপদেশকত্বাৎ বেদস্য তদুক্তত্বমর্থাৎলব্ধং। তেন হেতুনা বেদস্য প্রামাণ্যমনুমেয়ং। তত্র দৃষ্টান্তমাহ। মন্ত্রো বিষাদিনাশকঃ। আয়ুর্ব্বেদভাগশ্চ বেদস্য এব। তত্র সংবাদেন প্রামাণ্যগ্রহাৎ তদৃষ্টান্তেন বেদত্বাবচ্ছেদেন প্রামাণ্যমনুমেয়ং।”
যথার্থ উপদেশ প্রদত্ত হয়েছে, সত্যবাণী বিঘোষিত আছে, এজন্য বেদবাক্য প্রমাণরূপে পরিগৃহীত হয়ে থাকে। মন্ত্র-বিষ আদি নাশক; আয়ুর্ব্বেদ-বেদেরই অন্তর্গত। আয়ুর্ব্বেদ-শাস্ত্রের ফল প্রত্যক্ষ সম্যক দেখা যায়। সুতরাং আয়ুর্ব্বেদ প্রমাণ মধ্যে পরিগণিত। বেদও তেমনি প্রমাণ। বেদকে যে নিত্য ও প্রমাণ বলা হয়, তার আরও কারণ এই যে, বেদে অতীত অনাগত মন্বন্তর সম্প্রদায় অভ্যাস ও প্রয়োগ অবিচ্ছিন্ন আছে। বেদের উপদেশ যথার্থ। বহুকাল প্রচারিত হেতু বেদের নিত্যত্ব এবং এতে সত্যবাক্য আছে বলেই তা প্রামাণ্য। এ বিষয়ে বৃত্তিকার বাচস্পতি মিশ্রের উক্তি; যথা,-
“মন্বন্তরযুগান্তরেষু চ অতীতানাগতেষু সম্প্রদায়াভ্যাসপ্রয়োগাবিচ্ছেদো বেদানাং নিত্যত্বং।
আপ্তপ্রামাণ্যাৎ চ প্রামাণ্যং। লৌকিকেষু শব্দেষু চৈতৎ সমানং।”
এভাবে ন্যায়দর্শন বেদের প্রামাণ্য স্থাপন করে গেছেন। মীমাংসকেরা বেদের নিত্যত্ব ও প্রামাণ্য বিষয়ে আরও একটি যুক্তির অবতারণা করেন। অনেক সময় বিতর্ক উঠে থাকে, -শব্দের সাথে অর্থের একটি কল্পিত সম্বন্ধ আছে। সে সম্বন্ধ সঙ্কেতাত্মক, অর্থাৎ বোধ্য-বোধক ভাবমূলক। কল্পিত সেই সম্বন্ধ নিয়েই শব্দ ব্যবহৃত হয়। কল্পিত সেই সম্বন্ধ যে অনেক সময় ভ্রান্তিমূলক হয়, ঝিনুকে রূপার জ্ঞানই তার প্রমাণ। শব্দে যখন সত্যের অপলাপ অসম্ভব নয়, তখন বেদবাক্য-সকল কল্পনা সঙ্কেতাত্মক শব্দ বলে নিরর্থক ও অপ্রামাণ্য হতে পারে। এভাবে পূর্বপক্ষ স্থাপন করে, মীমাংসকগণ খণ্ডনের জন্য একটি সূত্রের অবতারণা করেছেন। এ সম্বন্ধে মীমাংসা দর্শনের একটি সূত্র ও তার ভাষ্য নিচে তুলে ধরা গেল; যথা-
ঔৎপত্তিকস্তু শব্দস্য অর্থেন সহ সম্বন্ধস্তস্য জ্ঞানমুপদেশঃ
অব্যতিরেকশ্চ অর্থে অনুপলব্ধে তৎপ্রমাণং বাদরায়ণস্য।
শব্দের ও অর্থের সম্বন্ধ অর্থাৎ বোধ্য-বোধক ভাব স্বাভাবিক ও অনিত্য। তাতে যে অস্বাভাবিকতা বা অনিত্যতা সূচিত হয়, তা বিভ্রম বা অজ্ঞানতানিবদ্ধন। ঝিনুকে রূপার জ্ঞান বিভ্রমেরই পরিচায়ক। ঝিনুক শব্দে ও রূপা শব্দে যে অর্থ উপলব্ধ হয়, সে শব্দের অর্থ অবিকৃতই আছে; ভ্রান্তি তার অর্থ-বৈপরীত্য ঘটেছে মাত্র। এ ভাবে বিচার করলে, শব্দ ও তার অর্থ নিত্য ও স্বাভাবিক বলেই প্রতিপন্ন হয়। বেদবাক্য প্রকৃত ধর্মজ্ঞান শিক্ষা দেয়। বেদবাক্য- প্রত্যক্ষ আদি প্রমাণ নিরপেক্ষ অজ্ঞাত বিষয়ের অভ্রান্ত উপদেশ প্রদান করে। সুতরাং বেদ নিত্য ও প্রামাণ্য।
প্রামাণ্যে অন্যান্য সংশয়-
বেদের প্রামাণ্য ও অপ্রামাণ্য বিষয়ে আরও যে সকল বিচার-বিতর্ক উপস্থিত হয়, তারও কতকগুলি উল্লেখ করছি। প্রমাণের দুইটি লক্ষণ সাধারণতঃ বলা হয়। যার দ্বারা সম্যক্ অনুভব সাধন হয়, অর্থাৎ যা ভ্রমশূন্য পূর্ণজ্ঞানের প্রকাশক, তাই প্রমাণ। প্রমাণের এই এক লক্ষণ। আর এক লক্ষণ- যা অনধিগত বা অজ্ঞাত বিষয় জ্ঞাপন করে, তাকেই প্রমাণ বলা হয়। প্রমাণ-সম্বন্ধে এই দুই লক্ষণ, দুই সম্প্রদায় কর্তৃক নির্দ্দিষ্ট হয়ে থাকে। পূর্বপক্ষ রূপে নৈয়ায়িকগণ বেদে ঐ দুই লক্ষণেরই অভাব ঘোষণা করেন। কতকগুলি বেদমন্ত্র বোধগম্য হয় না। যা বোধগম্যই নয়, তাতে আর কি জ্ঞান উন্মেষ সম্ভপর? মন্ত্রে আছে- (১) “সৃণ্যেব জর্ভরী তুর্ফরী তু”, (২) “অম্যকসাৎ ইন্দ্রঋষ্টিঃ”, (৩) “যাদৃশ্মিন্ধায়ি তমপস্যয়াবিদদ্”, (৪) “আপান্তমন্যুস্তৃপলপ্রভর্ম্মা”, ইত্যাদি। এ সকলের অর্থ পরিগ্রহ হয় না। যার অর্থবোধ হয় না, তার প্রামাণ্য কিভাবে স্বীকার করা যেতে পারে? একটি মন্ত্র আছে, -“অধঃস্বিদাসীদুপরিস্বিদাসীৎ”; অর্থাৎ- উপরে কি নীচে? মন্ত্রে এই ভাব ব্যক্ত থাকলেও, উহা স্থাণূ-সম্বন্ধে কি পুরুষ সম্বন্ধে প্রযুক্ত হয়েছে, তাতে সন্দেহ আসে। সুতরাং ঐ মন্ত্র প্রমাণ-স্বরূপ গ্রহণ করতে পারা যায় না। আবার অনেক স্থানে অচেতন পদার্থকে চেতনের ন্যায় সম্বোধন করা হয়েছে; যথা- (১) “ওষধে ত্রায়স্বৈনম্”; অর্থাৎ হে ওষধে! একে উদ্ধার কর; (২) “স্বধিতে মৈনং হিংসীঃ” অর্থাৎ হে ক্ষুর! এর প্রতি হিংসা করবে না; (৩) “শৃণোত গ্রাবাণ” অর্থাৎ হে পাষাণগণ তোমরা শ্রবণ কর; (৪) “আপ উন্দস্তু” অর্থাৎ হে জল! মস্তকের ক্লেদ দূর কর; (৫) “শুভিকে শির আরোহ শোভয়ন্তী মুখং মম” অর্থাৎ হে শুভিকে(টোপর)! আমার মুখের শোভা বর্ধন করতে মস্তকে আরোহণ কর। এই সকল স্থানে অচেতন পদার্থকে চেতন পদার্থ রূপে সম্বোধন করায়, মন্ত্রসমূহ অপ্রামাণ্য প্রতিপন্ন হয়। কোথাও ‘দুই চন্দ্র’ (দ্বৌ চন্দ্রমসৌ), কোথাও রুদ্র এক-দ্বিতীয় নাই (এক এব রুদ্রো ন দ্বিতীয়োহবতহস্থ) কোথাও হাজার হাজার রুদ্র পৃথিবীতে আধিপত্য করছেন (সহস্রাণি সহস্রশো যে রুদ্রা অধিভূম্যাম); এমন উক্তি আছে। এই সকল পরস্পর বিরুদ্ধ বাক্য প্রমাণ পক্ষে বিশেষ বিঘ্ন উপস্থিত করে। যদি কেউ বলেন,- “আমি যাবজ্জীবন মৌন আছি;” তাঁর সে বাক্য যেমন তাঁর মৌনতার বিঘ্ন-সাধক, ঐ সকল পরস্পর বিরুদ্ধ ভাবদ্যোতক মন্ত্রসকলও সেরূপ প্রমাণের ব্যাঘাত ঘটিয়ে থাকে। অতএব, বেদবাক্য প্রামাণ্য নহে।
সকল সংশয় নিরসনে।
পূর্ব্বোক্ত সংশয়-প্রশ্ন-সমূহের উত্তর মীমাংসক-সম্প্রদায়গণ প্রদান করে গেছেন। পূর্বপক্ষরূপে প্রশ্নগুলি উত্থাপন করে, উত্তরপক্ষরূপে তাঁরা যে তার উত্তরদান করেছেন, তারই আভাষ এখন প্রদান করা যাচ্ছে। যে সকল মন্ত্রের অর্থ হয় না বলেই বেদ বিরোধীগণ নির্দ্দেশ করেন, সেই সকল মন্ত্রের অর্থ যাস্কের “নিরুক্ত” গ্রন্থে বুঝানো হয়েছে। যাঁরা তা অবগত নন, তাঁরাই ঐ সকল মন্ত্রের উল্লেখ দেখে বেদের প্রামাণ্য পক্ষে দোষ প্রদর্শন করেন। এই উপলক্ষ্যে মীমাংসকদের একটি সূত্র দেখা যায়। সূত্রটি এই; “সতঃ পরমবিজ্ঞানম,।” অর্থাৎ পরম জ্ঞান লাভ হলেই, বিদ্যমান পদার্থের স্বরূপ উপলব্ধ হয়; অজ্ঞ জন অজ্ঞানতা নিবন্ধন সে জ্ঞান লাভ করতে পারে না। ‘জর্ভরী তুর্ফরী তু’ শব্দের অর্থ পালনকর্ত্তা সংহারকর্ত্তা। ‘জর্ভরী তুর্ফরী’ অশ্বিদ্বয়কে বুঝানো হয়ে থাকে। ঐ কারণেই সূক্তটির নাম আশ্বিন সূক্ত। অন্ধব্যক্তিরা যে বিশাল স্তম্ভ পর্য্যন্তও দৃষ্টি করতে সমর্থ নয়, সে দোষ স্তম্ভের নয়, সে দোষ অন্ধেরই। কেউ অর্থ বুঝল না বলে, বেদবাক্য যে অর্থহীন হবে, তার কোনই হেতু নির্দ্ধারণ করতে পারা যায় না। “অধঃস্বিদাসীৎ” ইতি মন্ত্রের অর্থ-পরবর্তী মন্ত্র পাঠ করলে উপলব্ধ হয়। ঐ অংশের স্থূল অর্থ- উপরে বা নীচে। উহা পরম পুরুষকে লক্ষ্য করে প্রযুক্ত হয়েছে। এতে উর্দ্ধে ও অধঃদেশে সর্ব্বত্র তাঁর বিদ্যমানতা প্রকাশ পেয়েছে। ওষধি, ক্ষুর, পাষাণ প্রভৃতিকে সম্বোধন করে যে সকল্প মন্ত্র উক্ত হয়েছে, তার সমুদায়ে জড় বা অচেতন পদার্থকে লক্ষ্য করা হয় নি; পরন্তু এদের অধিষ্ঠাত্রী দেবতাগণের উদ্দেশেই ঐ সকল মন্ত্র প্রযুক্ত হয়েছে। ঐ সকল মন্ত্র তন্ময়ত্ব ভাব জ্ঞাপক। বিশ্বেশ্বরের বিশ্বরূপে বিরাজমানতাই এর লক্ষ্য। যদি কেউ আপন স্বর্গীয় পিতৃদেবের প্রতিমূর্ত্তি চিত্রপট লক্ষ্য করে ভক্তিভরে প্রণাম করেন, সে প্রণাম কখনই চিত্রপটের উদ্দেশে নয়; সে প্রণাম, তাঁর পূজ্যপাদ পিতার উদ্দেশেই বিহিত হয়। সেরূপ ওষধি, পাষাণ বা ক্ষুর প্রভৃতির সম্বোধনে যে সকল মন্ত্র দেখতে পাই, তাদের অধিষ্ঠানভূত বিশ্বপাতাই সেই সকল মন্ত্রের লক্ষ্য। উত্তর-মীমাংসায় মহর্ষি বাদরায়ণ “অভিমানিব্যপদেশস্তু” এই সূত্রে এই সংশয়ের নিরসন করে গেছেন। সাধারণ-দৃষ্টিতে দুইটি মন্ত্র পরস্পর বিরুদ্ধ ভাবাপন্ন বলে বোধ হলেও, একটু সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখলে সে ভাব দূর হতে পারে। শব্দের ও বাক্যের অর্থ দুইরূপ দৃষ্ট হয়। এক অর্থ- লৌকিক; অপর অর্থ-ব্যবহারিক। পিতা ও মাতা এই দুই শব্দের সাধারণ অর্থ সকলেই অবগত আছেন। এই দুই শব্দে পালনকর্ত্তা পিতা এবং স্নেহময়ী জননী অর্থাৎ পুরুষ ও নারী স্বতন্ত্রভাবে দুই জনকে বুঝিয়ে থাকে। কিন্তু আবার এমনও দেখা যায়, ঐ দুই শব্দ একই উদ্দেশ্যে একই ব্যক্তির প্রতি প্রযুক্ত হয়েছে। লোকে সাধারণতঃ আপন উত্তমর্ণকে ও ভূস্বামীকে “আপনি আমার মা-বাপ” বলে সম্বোধন করে থাকে। সে ক্ষেত্রে আমরা ‘মা-বাপ’(মাতা-পিতা) শব্দদ্বয়ের লৌকিক অর্থ স্ত্রী ও পুরুষ-রূপে পরিকল্পিত হলেও, ঐরূপ ক্ষেত্রে সম্বধিত ব্যক্তিতে পিতার পালকতা ও মাতার স্নেহ-মমতা একাধারে বিদ্যমান আছে, ইহাই বুঝতে হবে। সেরূপ, “এক রুদ্র দ্বিতীয় নাই’ এবং ‘সহস্র সহস্র রুদ্র আধিপত্য করছেন’ এবম্বিধ বিপরীত ভাবসম্পন্ন মন্ত্রে কখনই বেদ-প্রামাণ্যে বিঘ্ন ঘটতেছে না। কেন না, ঐ অংশের সূক্ষ্ম অর্থ এই যে, সেই যে ব্রহ্ম-যিনি রুদ্ররূপে সম্পূজিত হন, তিনি এক হয়েও বহু এবং বহু হয়েও এক। যোগ প্রভাবে মানুষ বহুরূপ, ধারণ করতে সমর্থ হয়। সেখানে একে যেমন বহুত্বের প্রকাশ অসম্ভব হয় না, এ ক্ষেত্রে সেরূপ বিবেচনাও করা যেতে পারে। অতএব, তাঁহাকে কখনও একরূপে, কখনও বহুরূপে পরিচিত করায়, বেদপ্রামাণ্যে কোনই দোষ ঘটে না।
৩। অপৌরুষেয়ত্ব বিষয়ে বিতর্ক ও মীমাংসা। বেদ যে পৌরুষেয় তার পক্ষে যুক্তি-
বেদের অপৌরুষেয়ত্ব প্রমাণ পক্ষে প্রধানতঃ ত্রিবিধ যুক্তির অবতারণা দেখতে পাই। এক পক্ষ বেদকে সাধারণ মানুষের রচনা বলে ঘোষণা করেন। দ্বিতীয় পক্ষ একে অভ্রান্ত পুরুষের রচনা বলেন। তৃতীয় পক্ষ উহা ঈশ্বর-প্রণীত বলে সিদ্ধান্ত করেন। কালিদাস ‘রঘুবংশাদির’ রচয়িতা; ‘উত্তররাম চরিত’ প্রভৃতি ভবভূতির রচনা; বেদও তেমনি পুরুষ বিশেষের রচনা বলে বিতর্ক উপস্থাপন হয়। সাধারণ গ্রন্থ প্রভৃতি দেখে যেমন তার প্রণেতার বিষয় মনে আসে, বেদ দেখেও সে ভাব মনে আসবে না কেন? এই প্রথম পক্ষের সিদ্ধান্ত। আবার, নৈয়ায়িকগণ এক ভাবে, বৈশেষিক-দর্শন আর এক ভাবে এবং বেদান্ত অন্য আর এক ভাবে এ বিষয়ে অভিমত ব্যক্ত করে গেছেন। নৈয়ায়িকগণ বলেন- ‘বেদকর্ত্তা যথার্থবাদী হতে পারেন, বেদ অভ্রান্ত পুরুষের প্রণীত হতে পারে; কিন্তু উহা যে কারও রচনা নয়, তা বলা যেতে পারে না। কুম্ভকার ঘট প্রস্তুত করল; সে স্থানে ‘ঘট’ প্রস্তুত করল’ এই বাক্য নিশ্চয়ই সত্য। বেদে সেরূপ সত্য আছে বলেই উহা অভ্রান্ত-পুরুষের রচনা বলা যেতে পারে; কিন্তু উহা অপৌরুষের অর্থাৎ কারও রচিত নয় বলা যেতে পারে না। বাক্য অভ্রান্ত হলেই যে তা নিত্য ও অপৌরুষেয় হবে, তার কোনও কারণ নাই। তবে বেদ যখন অভ্রান্ত ও সত্যস্বরূপ, উহা ভ্রান্ত মানুষের রচনা হতে পারে না; উহা অভ্রান্ত-পুরুষের-ঈশ্বরের রচনা। ঈশ্বরের রচনা বলেই উহার প্রামাণ্য। তাছাড়া এর অপৌরুষেয়ত্ব নেই। বৈশেষিক-দর্শনের মতও অনেকাংশে ঐরূপ ভাবদ্যোতক। দর্শনকার সূত্রে(প্রথম অধ্যায়, প্রথম আহ্নিক, তৃতীয় সূত্র) বলেছেন,- “তদ্বচনাদাম্নায়স্য প্রামাণ্যম্।” অর্থাৎ বেদ ঈশ্বরবাক্য, অতএব প্রমাণ। অর্থান্তরে, বেদ ধর্ম-প্রতিপাদক ঈশ্বরবাক্য, সুতরাং প্রমাণ। বৈশেষিক-দর্শনের অন্য আর এক সূত্রে বিষয়টি আরও স্পষ্টভাবে বিবৃত দেখি। সেই সূত্র (ষষ্ঠ অধ্যায়, প্রথম আহ্নিক, প্রথম সূত্র)- “বুদ্ধিপূর্ব্বাবাক্যকৃতির্বেদে।” অর্থাৎ, বেদবাক্য রচনা বুদ্ধিপূর্ব্বক হয়েছে। বেদে বিধি নিষেধ রূপ যে সকল বাক্য আছে, তা ধর্ম-মূলক। ধর্মাধর্মের প্রমাণ তাই বেদ। সর্ব্বজ্ঞ ঈশ্বর সে বেদ রচনা করেছেন বলেই তার অভ্রান্ততা। ‘স্বর্গকামো যজেৎ’; অর্থাৎ, যাগযজ্ঞই স্বর্গকামী ব্যক্তির ঈষ্টসিদ্ধির কারণ; ‘গাং মা বধিষ্ঠাঃ’; অর্থাৎ, গো-বধ করিও না; কেননা, ইহা স্বর্গকামী ব্যক্তির ইষ্টসিদ্ধির অন্তরায়;- এই প্রকার যে বেদোক্ত বিধি-নিষেধ, ইহা কি কখনও মানুষে রচনা করতে পারেন? স্বর্গ অপবর্গের কথা সাধারণ মানুষের অধিগম্য নয়। এমন যুক্তির অবতারণা করেই বৈশেষিক দর্শন ধর্মাধর্ম প্রতিপাদ্য বেদকে ঈশ্বরবাক্য বলে ঘোষণা করে গেছেন। যার অসংখ্য শাখা, যার অশেষ সন্মান, বৈশেষিকের মতে, তা অভ্রান্ত-পুরুষের- ঈশ্বরের রচনা ভিন্ন কারও রচনা হতে পারে না। এইমতে, বেদ ঈশ্বর-প্রেরিত এবং মহাজনগৃহীত; আর, তার জন্যই এর প্রামাণ্য। বেদ-বিষয়ে বেদান্ত-দর্শনের যে সিদ্ধান্ত, তাতেও এইপ্রকার অভিমত অভিব্যক্ত। বেদ যে ব্রহ্ম হতে উৎপন্ন হয়েছে, ‘শাস্ত্রযোনিত্বাৎ’ (বেদান্ত-দর্শন, প্রথম পাদ, তৃতীয় সূত্র) সূত্রে এ তত্ত্ব ব্যক্ত। বেদ ব্রহ্ম হতে উৎপন্ন, ব্রহ্মই বেদের সৃষ্টিকর্ত্তা; উক্ত সূত্রে এই অর্থ প্রতিপন্ন হয়। ফলতঃ, সাধারণ পুরুষ বা মনুষ্য নয়; পরম-পুরুষ পরমেশ্বর কর্তৃক বেদ সৃষ্ট হয়েছিল। বেদের পুরুষ-সুক্ত মন্ত্র অনুসারেও বেদকে পৌরুষেয় বলা যেতে পারে। কেন-না, উক্ত সূক্তে বেদ-বিধাতা ভগবানকে ‘সহস্রশীর্ষা পুরুষঃ সহস্রাক্ষঃ সহস্রপাৎ’ অর্থাৎ সহস্র-মস্তক সহস্র চক্ষু ও সহস্র-পাদ-বিশিষ্ট পুরুষ বলা হয়েছে। সেই পুরুষ হতেই যখন বেদ উৎপন্ন, তখন বেদকে অবশ্যই পৌরুষেয় বলেই অঙ্গীকার করতে হয়।
বেদের অপৌরুষেয়ত্বে প্রমাণ-
এই প্রকারে বেদের পৌরুষেয়ত্ব-স্থাপনে যে সকল বিতর্ক উত্থাপিত হয়, বিবিধ যুক্তি দ্বারা তার সমস্ত খণ্ডনের প্রয়াস দেখতে পাই। প্রথমতঃ, কালিদাস ভবভূতির ন্যায় কোনও মানুষ যে বেদ-রচয়িতা ছিলেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় না। কালিদাস ‘রঘুবংশ’ প্রণয়ন করেছিলেন; ভবভূতি কর্তৃক ‘উত্তররামরচিত’ বিরচিত হয়েছিল; -এর সাক্ষ্য পুরুষ-পরম্পরা ক্রমে প্রাপ্ত হওয়া যাচ্ছে। কিন্তু বেদ-প্রণেতার কোনই পরিচয় নেই। কেউ হয় তো মনে করতে পারেন, মধুচ্ছন্দা ঋষি প্রভৃতি যাঁদের নামে বৈদিক সূক্তসমূহ প্রচারিত আছে, তাঁরই বুঝি সেই সেই সূক্তের রচয়িতা। কিন্তু এ বিষয় পূর্ব্বেই প্রতিপন্ন করা হয়েছে যে, তাঁদের কে মন্ত্রের রচয়িতা বলা যেতে পারে না; তাঁরা মন্ত্রের প্রবর্ত্তক মাত্র। তারপর, বৈশেষিক দর্শনের এবং বেদান্ত-দর্শনের সিদ্ধান্তের আলোচনায় বেদ যে পরমেশ্বর-রচিত বলেই সূচিত হয়, তার দ্বারাও এর পৌরুষেয়ত্ব প্রতিপন্ন হয় না। কেন-না, পুরুষ বলতে – মানুষ বলতে, কর্মফল-হেতুভূত এই জন্মজরামরণশীল দেহধারী জীবকেই বুঝায়। কর্মের ফলে জীবকে নরদেহ ধারণ করতে হয়। সেই নরদেহধারী জীবই সাধারণতঃ পুরুষ নামে খ্যাত। কিন্তু জগৎপাতা জগদীশ্বর সেরূপ পুরুষ নন। আবশ্যক অনুসারে পুরুষ-রূপে আবির্ভূত হলেও, তিনি সাধারণ পুরুষের অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন না; কেনন-না, কর্মফলের অধীন হয়ে, কর্মফলভোগ-হেতু তাঁকে সংসারে আসতে হয় নি; সুতরাং পুরুষ হয়েও তিনি পুরুষাতীত। আর, সে অনুসারে পৌরুষের হয়েও তাঁর রচনা অপৌরুষেয়। এই পৌরুষেয় -অপৌরুষেয় প্রসঙ্গে সাংখ্য মতাবলম্বিদের যুক্তি আবার আরেক প্রকার। তাঁরা বলেন, ‘পুরুষ নিষ্ক্রিয় মুক্ত সৎস্বরূপ। কোনও বিষয়ে তাঁর ইচ্ছাই আসতে পারে না। সুতরাং তিনি যে বেদ রচনা করেছেন, তা কিভাবে বলতে পারি?-ইচ্ছাপূর্ব্বক কোনও কার্য্য করা-বদ্ধ-পুরুষের লক্ষণ। অতএব, বুদ্ধিপূর্ব্বক বেদ রচনা হয়েছে যদি স্বীকার করা যায়, তাহলে পুরুষকে পরমেশ্বরকে বদ্ধ-জীব বলেই স্বীকার করতে হবে। বদ্ধজীবে মুক্ত-সত্য-ভাব কখনই সম্ভবপর নয়। পুরুষ মুক্ত সত্য; সুতরাং বেদ তাঁর রচনা হতে পারে না।’ তবে তাঁর থেকে বেদ কিভাবে উৎপন্ন হতে পারে? সাংখ্যগণ উত্তরে বলেন,- ‘অদৃষ্টবশতঃ স্বয়ম্ভূ ব্রহ্মার নিশ্বাসের ন্যায় বেদের উৎপত্তি হয়েছে। পুরুষ হতে অনুসৃত হলেই যে তা পৌরুষেয় হল, তা বলতে পারি না। সুষুপ্তি-কালে, নিদ্রিত অবস্থায়, মানুষের নিশ্বাস-প্রশ্বাস নির্গত হয়। তাকে কি ইচ্ছাকৃত পৌরুষেয় সংজ্ঞায় অভিহিত হয়ে থাকে। পুরুষ-যিনি পরমপুরুষ, তাঁতে ইচ্ছা ও অনিচ্ছা কিছুরই আরোপ করা যায় না। সুতরাং বেদ পৌরুষেয় নহে। তবে বেদ কোথা হতে আসল? সাংখ্যগণ উত্তরে বলেন,-বেদ অনাদি; বীজাঙ্কুরবৎ। বৃক্ষ আদি, কি বীজ আদি-ইহা যেমন নির্ণয় হয় না; জ্ঞান-রূপ বেদেরও সেরূপ উৎপত্তি ও লয় নির্ণয় হয় না। যা পুরুষ(সাধারণ মনুষ্য) কৃত, তার উৎপত্তি ও বিনাশ আছে। কিন্তু জ্ঞানের আদি-অন্ত কে নির্ণয় করতে পারে?’ সুতরাং বেদ অনাদি অপৌরুষেয়।
No comments:
Post a Comment
Thank you for your message, I see all your messages, it is not possible to reply many times due to busyness, I hope I will reply to everyone in time, thank you for being with me. Thanks you watching my content. Please like, Follow, Subscribe.