ঋগ্বেদ পরিচয় – (৩) ঋগবেদের কাল
null
ঋগ্বেদ পরিচয় – (৩) ঋগবেদের কাল
ঋগবেদের কাল নির্ণয় নিয়ে মতের অনেক পার্থক্য আছে। সর্বাপেক্ষা প্রাচীন হতে অপেক্ষায় অধুনাতমকালে তাকে স্থাপন করবার চেষ্টা হয়েছে। এদের ব্যবধান কয়েক সহস্র বৎসর। নানা মনীষী এই প্রসঙ্গে যে সকল তথ্য দিয়েছেন সেগুলি বিবেচনা করে একটি যুক্তিসম্মত কাল নির্দেশ করতে হবে। প্রথমে বিভিন্ন মতগুলি স্থাপন করা যেতে পারে।
অধ্যাপক হেরমান জাকোবির মত অনুসারে বৈদিক সাহিত্যের রচনার কাল খৃষ্টপূর্ব ৪০০০ বৎসর। বাল গঙ্গাধর তিলকও অনুরূপ মত পোষণ করতেন মনে হয়।
প্রচলিত ধারণা আছে যে বেদব্যাস বেদগুলি চারভাগে সংকলন করেছিলেন। আমরা জানি তিনি মহাভারতের যুগের মানুষ। হোরেস হেম্যান উইলসনের ধারণায় বেদব্যাস এই সংকলন কার্য সম্পাদন করেন যুধিষ্ঠিরের পৃষ্ঠপোষকতায় (Rigveda Samhita Vol.1, Introduction)। সুতরাং এই প্রসঙ্গে মহাভারতের কাল নির্ণয় প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
আমাদের দেশে একটা ধারণা আছে যে দ্বাপরের শেষে কলিযুগের আরম্ভ হয় খৃষ্টপূর্ব ৩১০১ বর্ষে। ঐতিহ্য অনুসারে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ সংঘটিত হয় দ্বাপর যুগের শেষে। সুতরাং এই যুক্তির ভিত্তিতে মহাভারতের ঘটনাকে খৃষ্টপূর্ব ৩২০০ অব্দে ঠেলে নিয়ে যাওয়া যায়। ফলে বেদের রচনার কাল তারও কিছু পুর্বে নির্ধারণ করা যায়। কিন্তু মহাভারতের কাল নির্ণয়ের চেষ্টা একাধিক মনীষী ভিন্নভাবেও করেছে।
তাঁদের মধ্যে ইংরেজ ভারততত্ত্ববিদ এফ.ই. পার্জিটার অন্যতম। পুরাণসমূহে প্রাচীন ভারতের রাজবংশ এবং রাজাদের তালিকা দেওয়া আছে। সেইসব তালিকা হতে যে তথ্য উদ্ধার করা গেছে তাকে ভিত্তি করে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে মহাভারতে বর্ণিত কুরু-পান্ডবদের যুদ্ধের কাল হল আনুমানিক খৃষ্টপূর্ব ৯৫০ অব্দে অর্থাৎ খৃষ্টপূর্ব দশম শতকের মধ্যভাগে।
ঐতিহাসিক হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী পার্জিটারের অনুসৃত পথ অনুমোদন করেন নি। তাঁর ধারণায় পুরাণগুলিতে বর্ণিত রাজবংশের তালিকাগুলির কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই এবং অনেক সময় কাহিনীগুলি কল্পিত। তাই তিনি পুরাণ গুলি হতে লব্ধ তথ্যকে উপেক্ষা করেছেন। তিনি নির্ভর করেছেন বৈদিক সাহিত্যের অন্তর্ভূক্ত ব্রাহ্মণাদি গ্রন্থে যে রাজবংশ, রাজা, ঋষি ও ঋষি পরম্পরার উল্লেখ আছে তাদের মধ্য হতে সংগৃহীত তথ্যের ওপর। এই তথ্যকে ভিত্তি করে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে মহাভারতের যুদ্ধ সংঘটিত হয় খৃষ্টপূর্ব দশম শতকে।
সুতরাং যদিও পার্জিটার ও হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী বিভিন্ন তথ্যের উপর নির্ভর করেছেন, তাঁদের সিদ্ধান্ত একই দাঁড়িয়েছে। এই সিদ্ধান্ত অনুসারে তাহলে চারটি বেদের সংকলন কাল নির্ধারিত হয়ে যায় খৃষ্টপূর্ব দশম শতাব্দীতে। এই সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ঋগবেদের রচনাকাল আরও দু’এক শতাব্দী আগে টেনে নিয়ে যাওয়া যায়। আমরা দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে আলোচনা করে দেখিয়েছি যে অথর্ববেদের আবিস্কার হয় সবার শেষে এবং ব্রাহ্মণের যুগে পর্যন্ত তিনটি বেদের অস্তিত্বই মানুষ জানত। অপর পক্ষে তিনটি বেদের মধ্যে ঋগ্বেদ প্রাচীনতম। ঋগবেদের যে এক হাজারের উপর সূক্ত আছে সেগুলিও রচিত হয়েছিল দীর্ঘকাল ধরে। সুতরাং ঋগবেদের রচনাকাল এক শতাব্দী কাল ধরে বিস্তারিত ছিল ধরে নেওয়া যায়। যদি ধরে নেওয়া যায় অথর্ববেদের আবির্ভাব হয়েছিল ঋগবেদের শতবৎসর পরে, তাহলে ঋগ্বেদের কাল কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় হতে আরও দুই-শতাব্দী এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। সুতরাং এই যুক্তির ভিত্তিতে ঋগবেদের কাল নির্ণীত হওয়া উচিত খৃষ্টপূর্ব দ্বাদশ শতাব্দীতে।
ভাষাতত্ত্ববিদ ডঃ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ভাষাতত্ত্বের ভিত্তিতে ঋগবেদের কাল নির্ণয় করেছেন। তাঁর অভিমত এইরূপঃ ইরানের প্রাচীন আর্য ভাষা দুটি – আবেস্তার ভাষা ও প্রাচীন পারসীক ভাষা। এই দুটি ভাষার সহিত বৈদিক সংস্কৃত ভাষার অনেক সাদৃশ্য দেখা যায়। আবেস্তার প্রাচীনতম অংশ হল তার গাথা অংশ। তার আনুমানিক রচনাকাল খৃষ্টপূর্ব ৬০০।
বৈদিক ভাষা ও আবেস্তার ভাষার যে বৈসাদৃশ্য দেখা যায়, অনুমান করা হয়, কয়েক শতাব্দী পুর্বে যখন বৈদিক আর্যগণ ও পারসীক আর্যগণ একসঙ্গে বাস করতেন তখন তা ছিল না। ডঃ চট্টোপাধ্যায়ের ধারণা এই বৈসাদৃশ্য গড়ে উঠতে তিন’শ বা চার’শ বছরের বেশী লাগা উচিত নয়। সুতরাং তাঁর ধারণায় ঋগবেদের রচনাকাল ১০০০ হইতে ৯০০ খৃষ্টপূর্বাব্দে ফেলা যায়। সুতরাং তিনি পার্জিটার ও হেমচন্দ্র রায়চৌধুরীর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে প্রস্তুত আছেন। (রমেশচন্দ্র দত্তের ঋগ্বেদ সংহিতা, তৃতীয় সংস্করণ ভূমিকা)।
এই প্রসঙ্গে জার্মান-ভারত তত্ত্ববিৎ ম্যাক্সমূলার-এর অভিমত বিবেচনা করা যেতে পারে। আমরা জানি ঋগবেদের সংহিতা অংশ সব থেকে প্রাচীন এবং বেদগুলির ব্রাহ্মণ গুলি রচিত হয় তারপরে। প্রাচীন উপনিষদগুলির আবির্ভাব হয় আরও পরে। এই ভিত্তিতেই ম্যাক্সমূলার-এর চিন্তা স্থাপিত। তাঁর যুক্তি এইরূপঃ
আমরা জানি যে ভগবান বুদ্ধের আবির্ভাবকাল ছিল খৃষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী। তাঁর সময় উপনিষদ প্রচলিত ছিল। সুতরাং উপনিষদের কালকে খৃষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে ফেলা যায়। সুতরাং ব্রাহ্মণগুলির রচনার কাল খৃষ্টপূর্ব সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দীতে স্থাপন করা যায়। কাজেই ঋগবেদের প্রাচীন অংশকে খৃষ্টপূর্ব একাদশ বা দ্বাদশ শতাব্দীতে ঠেলে দেওয়া যায়। তাঁর ধারণায় ঋগবেদ সম্ভবত আরও প্রাচীন।
ম্যাক্সমূলার-এর সিদ্ধান্তটি অন্যভাবেও পরীক্ষা করে নিতে পারি। ছান্দোগ্য উপনিষদের তৃতীয় অধ্যায়ের ষোড়শ ও সপ্তদশ খন্ডে পুরুষ যজ্ঞের বর্ণনা আছে। সেখানে একটি মানুষের সমগ্র জীবনের সহিত একটি যজ্ঞ সম্পাদনের তুলনা করে হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে কৃচ্ছ্রসাধন দীক্ষার স্থান গ্রহণ করে, জীবনে ভোগ উপসৎ এর স্থান গ্রহণ করে, প্রীতিপুর্ণ আচরণ স্তুতশাস্ত্রের স্থান অধিকার করে। তপস্যা, দান, আর্জব ও অহিংসা সেই যজ্ঞের দক্ষিণা স্বরূপ এবং মরণ অবভৃথ বা সমাপ্তি স্বরূপ। এই প্রসঙ্গে আরও বলা হয়েছে অঙ্গিরস পুত্র ঘোর ঋষি এই যজ্ঞের কথা দেবকী পুত্র কৃষ্ণের নিকট ব্যাখ্যা করেছিলেন।
এখন মহাভারতকে ঐতিহাসিক গ্রন্থ বলে স্বীকার করা হয়। তাতে বর্ণিত কুরু-পান্ডবের যুদ্ধকেও ঐতিহাসিক ঘটনা বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এখন দেখা যাচ্ছে মহাভারতের অন্যতম নায়ক ঐতিহাসিক পুরুষ কৃষ্ণের ছান্দোগ্য উপনিষদে উল্লেখ আছে। সুতরাং এই উপনিষদের রচনাকাল মোটামুটি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সমসাময়িক বলে ধরে নেওয়া যায়। ঐতিহাসিকদের সিদ্ধান্ত হল মহাভারতে বর্ণিত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ সংঘটিত হয় খৃষ্টপূর্ব দশম শতকে। সুতরাং ধরে নেওয়া যেতে পারে প্রাচীন উপনিষদগুলি এর সমসাময়িক। তা যদি হয় তাহলে ব্রাহ্মণগুলি তারও পূর্বে রচিত এবং ঋগবেদের প্রাচীন অংশ তারও আগে রচিত। ব্রাহ্মণগুলি যদি আরও একশ বছর প্রাচীন হয় এবং ঋগবেদ সংহিতা তারও একশ বছর আগে রচিত হয়েছে অনুমান করা যায় তাহলে ঋগবেদের রচনাকাল দাঁড়ায় খৃষ্টপূর্ব দ্বাদশ শতক। এই সিদ্ধান্ত ম্যাক্সমূলার-এর সিদ্ধান্তের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে।
প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার ফলে বর্তমানকালে মানুষের প্রাচীন ইতিহাসের এক নতুন দিগন্ত আবিস্কৃত হয়েছে। তাতে ভাল করে না হলেও প্রাগৈতিহাসিক যুগের মোটামুটি একটি ইতিহাস খাড়া করা যায়। তার অবলম্বন হল ঢিপি খুঁড়ে প্রাচীনকালের বসতির মধ্যে আদিম মানুষের যে সাংস্কৃতিক নিদর্শন পাওয়া যায় তাই। যেমন, মৃতপাত্র, পাথরের কুচি, কঙ্কাল এবং তার সঙ্গে প্রোথিত অন্য জিনিসপত্র। আদিমানব অনেক ক্ষেত্রে শীত হতে পরিত্রাণের জন্য গুহার বাস করত। সেখানে তার রাখা কিছু চিত্রের নিদর্শনও পাওয়া যায়। যেমন সংস্কৃতির অগ্রগতি হতে লাগল তেমন যন্ত্রাদিরও উন্নতি হতে লাগল। পাথরের কুচি আরও সুদৃশ্য ও মসৃণ হল। হাড়ের লাঙ্গল হল। পরবর্তীকালে তামার বা ব্রোঞ্জের অস্ত্রাদির আবির্ভাব হল। তারও পরবর্তীকালে চাষ আবিস্কার হল, অশ্বযান এল। এমন কি গণনা রীতি এবং লিপিও আবিস্কৃত হল।
বৈদিক যুগের মানুষ ভারতে এসেছিল বাহির হতে এবং তারাও প্রাগৈতিহাসিক যুগের অন্তর্ভূক্ত। পূর্বে ধারণা ছিল আদিম ভারতীয়গণ অসভ্য ছিল এবং আর্যগণই প্রথম এসে সভ্যতার বিস্তার করে। কিন্তু সে ধারণা এখন প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার ফলে ভেঙে পড়েছে। উত্তর-পশ্চিম ভারতে হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোতে এক উচ্চস্তরের নগরভিত্তিক সভ্যতার অস্তিত্বের প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া গেছে। তা প্রাগৈতিহাসিক মিশরীয় ও ইউফ্রেটিস উপত্যকার সুমেরীয় সংস্কৃতির সমসাময়িক বলে প্রত্নতত্ত্ববিদদের ধারণা। সুতরাং তা বৈদিক যুগের আগেই ভারতে সসম্মানে অধিষ্ঠিত ছিল। এইসব নূতন আবিস্কারের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে বৈদিক আর্যদের ভারতে আগমন এবং ঋগবেদের কাল নির্ণয় করা প্রশস্ত হবে।
প্রাগৈতিহাসিক যুগকে প্রত্নতাত্ত্বিকগণ তিনটি অধ্যায়ে ভাগ করেন। প্রথম অধ্যায়ে প্রাচীন প্রস্তর যুগ। তখন মানুষ আগুন জ্বালাতে শিখেছে। তার জীবিকা ছিল খাদ সংগ্রহ করা। খাদ্য উৎপাদন করতে তখনও সে শেখেনি। তার ব্যবহৃত প্রধান অস্ত্র ছিল ভোঁতা পাথরের কুচি। তারপর দ্বিতীয় পর্যায় এল এক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। মানুষ তখন খাদ্য উৎপাদন করতে শিখল। পশুপালন ও কৃষি তার জীবিকার অবলম্বন হল। ফলে জীবনের রীতি একেবারে পরিবর্তত হয়ে গেল। তারপর আর একটি বিপ্লব এল। তখন মানুষ ধাতুর ব্যবহারের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে। সে পঞ্জিকা উদ্ভাবন করেছে এবং তার লিপিজ্ঞান হয়েছে। তখন সে নগরভিত্তিক সংস্কৃতি গড়ে তুলল। এই তিনটি অধ্যায়ের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ আমরা স্থাপন করবার প্রস্তাব করি।
ই গর্ডন চাইল্ড-এর ধারণায় (Man Makes Himself) প্রাচীনতম প্রস্তর যুগের আরম্ভ হয় সম্ভবত ২,৫০,০০০ লক্ষ বৎসর পূর্বে এই যুগ স্থায়ী হয় প্রায় দু’লক্ষ বছর। সুতরাং মানুষের সংস্কৃতি প্রায় স্থাণু অবস্থায় দীর্ঘকাল রয়ে গিয়েছিল।
অনুমান করা হয় এই যুগের মানুষ আগুন জ্বালাতে শিখেছিল। তারা পাথরের ফলক যন্ত্র হিসাবে ব্যবহার করত। জন্তুর হাড়ও যন্ত্র হিসাবে ব্যবহার করত। তাদের জীবিকার অবলম্বন ছিল খাদ্য সংগ্রহ করা; কারণ তখন তারা খাদ্য উৎপাদন করতে শেখেনি। অর্থাৎ তারা পশু, পাখী, মাছ প্রভৃতি শিকার করত এবং ফলমুল সংগ্রহ করত। এই উপায়েই তাদের দেহের পুষ্টির ব্যবস্থা ছিল। ঠিক কিভাবে তারা জীবনধারণ করত তা অনুমানের বিষয়। তবে ধরে নেওয়া হয় তারা পশু, পাখী, মাছ, টিকটিকি, ফল, ঝিনুক, ডিম প্রভৃতি সংগ্রহ করে খেত। তারা মাটি খুঁড়ে মূল এবং অন্য খাদ্য সংগ্রহ করত। এটাও অনুমান করা হয় যে তারা পশুর চামড়া হতে পোশাক বানাত। তারা আগুন জ্বালতে শিখেছিল এবং পশুর মাংস আগুনে ঝলসিয়ে খেত।
এই যুগের নিদর্শন হিসাবে পিকিং-এর নিকটে অবস্থিত চু-কু-টিয়েন-এর এক গুহায় কিছু তথ্য পাওয়া গিয়েছে। সেখানে সে যুগের মানুষের কিছু কঙ্কাল, অধুনালুপ্ত জন্তুর কঙ্কাল, অগ্নিদগ্ধ হাড় এবং ভোঁতা পাথরের ফলক পাওয়া গিয়েছে। এদের কপালের হাড় আধুনিক মানুষ হতে অনেক পুরু ছিল এবং ভুরুর ওপরে উঁচু হয়ে উঠেছিল। এর থেকে মনে হয় সেকালের মানুষের দৈহিক ক্রমবিকাশ তখনও চলেছিল। তারা গুহায় বাস করত এবং প্রধানত শিকার বৃত্তি অবলম্বন করে জীবনধারণ করত। পোড়া হাড় থেকে অনুমান করা যায় তারা আগুনের ব্যবহার জানত। (*Paul Sanet,Man in Search of Ancestors.)
তারপর প্রায় দু’লক্ষ বৎসর পরে আমরা এক নূতন সংস্কৃতির সন্ধান পাই। এখন হতে পায় ৫০,০০০ বছর পূর্বে শেষ বরফের যুগের আবির্ভাবের পুর্বে ইউরোপে একশ্রেণীর মানুষের আবির্ভাব হল যাদের মুসটারিয়ান (Mousterions) বলত। অত্যন্ত ঠান্ডা পরিবেশের জন্য তারা সাধারণত গুহার বাস করত। তাদের দৈহিক গঠন বর্তমান মানুষের থেকে কিছু পৃথক ছিল। তাদেরও কপালের হাড় উঁচু ছিল। মাথাগুলো তারা ঠিক সোজা করে রাখতে পারত না এবং পা ঘসটে চলত। তাদের নিয়ান্ডার্টাল (Neandertal) মানুষ বলা হত। তারা এখন লোপ পেয়ে গিয়েছে। তারা বড় বড় জন্তু শিকার করত, যেমন ম্যামথ এবং পশম ঢাকা গন্ডার। ফাঁদ পেতে তারা এই সব বড় শিকার ধরত। সুতরাং অনুমান করে যায় তারা ভাষার ব্যবহার জানত; কারণ এই শিকার করতে অনেক মানুষের একযোগে কাজ করা প্রয়োজন। তারা মৃতকে কবর দিত। ফ্রাসে লা শাপেল ও স্যাঁ-এর (La Chapelle aux Saints) গুহার এ রকম কবরের মধ্যে মনুষ্য কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছে।
কয়েক সহস্র বৎসর পরে ইউরোপের আবহাওয়ার কিছু উন্নতি হল। তখন দেখি নিয়ানডারটাল মানুষ অপসৃত হয়েছে। তার জায়গায় যে মানুষের আবির্ভাব হয়েছে আকৃতিতে সে বর্তমান মানুষের মতই দেখতে। এই ধরনের মানুষের এই সময় উত্তর আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়ায়ও আবির্ভাব হয়েছিল।
এরা যে সংস্কৃতির বাহক তাকে পরিণত পুরাতন প্রস্তর যুগ (Upper Paleolithic age) বলা হয়। পরিবেশের সঙ্গে যুদ্ধ করবার হাতিয়ার হিসাবে তারা অনেক নতুন যন্ত্র বা অস্ত্র উদ্ভাবন করেছিল। শুধু পাথর নয়, হাতীর দাঁত এবং হাড় দিয়েও তারা যন্ত্র তৈরি করত। তারা ধনুক উদ্ভাবন করেছিল এবং বল্লম ছোঁড়বার জন্যও এক প্রকার যন্ত্র উদ্ভাবন করেছিল।
এই সংস্কৃতির সব থেকে উৎকৃষ্ট নিদর্শন পাওয়া যায় ফ্রান্সের মধ্যবর্তী অঞ্চলে। এই অঞ্চলের পরিবেশ খাদ্য সংগ্রহ করে জীবনধারণের বিশেষ উপযোগী ছিল। এখানে বিস্তৃত তৃণভূমি ছিল যেমন এখন সাইবেরিয়ায় আছে। সেখানে ম্যামথ, হাতী, বল্লা হরিণ, বাইসন, ঘোড়া এবং অন্য শ্রেণীর তৃণভোজী জীব চরত। দোর দঙে (Dordogne) ও ভেজের (Vezere) নদীতে প্রতি বৎসর অনেক স্যামন (Salmon) মাছ উঠত। উপত্যকার ধারে ধারে অনেক গুহা ছিল। এখানে প্রথমে অরিগনাসিয়ান (Aurignacian) ও পরে মাদলিনিয়ান (Magdalenians) জাতি এক আদর্শ সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিল। খাদ্য সংগ্রহের ওপর নির্ভরশীল এমন উচ্চমানের সংস্কৃতি আর দেখা যায় না।
এরা ধনুক এবং বল্লম ছোঁড়বার যন্ত্র ব্যবহার করতে জানত। সম্ববত মাদলিনিয়ারা এই সড়কি ছোঁড়বার যন্ত্র উদ্ভাবন করেছিল। তারা দলবদ্ধভাবে বড় বড় জন্তু শিকার করত এবং গুহায় বাস করত। মাদলিনিয়ানরা বঁড়শি ও হারপুন দিয়ে মাছ ধরত। তারা যে গুহার বাস করত সেখানে ভুমধ্যসাগর হতে আনীত কড়ি পাওয়া গিয়েছিল। তা প্রমাণ করে সম্ভবত বাহিরের মানবগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের আদান প্রদান চলত।
এই সংস্কৃতির দক্ষতা সব থেকে পরিস্ফুট হয়েছিল নানা শিল্পবস্তু সৃষ্টির মধ্য দিয়ে। তারা হাতীর দাঁত বা পাথরের মূর্তি খোদাই করত, মাটি দিয়ে নানা জন্তুর মূর্তি গড়ত, অস্ত্রগুলি কারুকার্য খচিত করত এবং গুহার দেয়ালে বা ছাতে মূর্তি আঁকত বা খোদাই করত। এদের গুহার চিত্র এবং খোদাই কার্য বড় বিচিত্র এবং বেশ উচ্চমানের ছিল। প্রথম যুগের চিত্রগুলি রেখাচিত্র। আঙুলে কাদা মাখিয়ে তা দেয়ালে আঁকা হত, কিম্বা পাথরের ফলক দিয়ে আঁচড় কেটে আঁকা হত, কিম্বা কাঠ কয়লা দিয়ে আঁকা হত। এগুলি প্রথম যুগের চিত্র এবং সম্ভবত আরিগনাসিয়ানদের আঁকা।
মাদলিনিয়ানদের সময় অঙ্কন রীতি ও ভাস্কর্য আরও উন্নত হয়েছিল। তারা চিত্রগুলি রঞ্জিত করত এবং রঙের ঘনত্ব দিয়ে গভীরতা বা তৃতীয় আরতি ফোটাত। সেই প্রাচীন যুগের মানুষের পক্ষে এটি একটি মস্তবড় কৃতিত্ব। এই চিত্র ও ভাস্কর্যগুলি গুহার গভীর অঞ্চলে অঙ্কিত বা খোদাই করা হত। সেখানে দিনের আলো বড় একটা পৌছাত না। কাজেই অনুমান করা যায়, কৃত্রিম আলোর সাহায্যে শিল্পী কাজ করত। গুহাগুলির মধ্যে পাথরের প্রদীপ পাওয়া গেছে। কাজেই অনুমান করা যায় চর্বি দিয়ে প্রদীপ জ্বেলে এই শিল্প কর্মগুলি চিত্রিত বা খোদাই করা হত। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে এই সব জীবজন্তু চিত্রিত করার পেছনে একটি ব্যবহারিক উদ্দেশ্য ছিল। তা হল ছবি এঁকে যাদু শক্তির সাহায্যে পশুশিকারে সাফল্য অর্জন করা। তার সপক্ষে দুটি যুক্তি দেখানো হয়েছে। প্রথম, তা না হলে এত কষ্ট করে এই শিল্প কর্মগুলি সৃষ্টি করা হত কেন? দ্বিতীয়ত এইসব পশুদের দেহে অনেক সময় বিদ্ধ অবস্থায় তীর দেখানো হয়েছে। তা নাকি তাদের মূল উদ্দেশ্যের পরিচয় দেয়। সে যাই হোক আদি মানুষের সৃষ্ট এই চিত্রগুলি তাদের শিল্পশক্তির সুন্দর পরিচয় দেয়।
তারপর শেষ তুষার যুগের কয়েক শতাব্দী পরে মানুষের সংস্কৃতির জীবনে প্রথম বিপ্লব এল। এতদিন তার জীবিকার ভিত্তি ছিল খাদ্য সংগ্রহ। এখন তার জীবিকার ভিত্তি হল খাদ্য উৎপাদন। অর্থাৎ সে চাষ করে শস্য উৎপাদন করতে শিখল। প্রথম যুগে গম ও যবই সে খাদ্যশস্য হিসাবে উৎপাদন করতে শিখল। সঙ্গে সঙ্গে পশুপালনও করতে শিখল। এই পশুগুলি ছিল শৃঙ্গবিশিষ্ট এবং তৃণভোজী। তাদের ব্যবহারের সুবিধা এই যে তাদের মাঠে চরিয়ে খাওয়ান যায়। অপর পক্ষে শস্য ঝাড়াই-এর পর যে খড় অবশিষ্ট থাকে তাও তাদের খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করতে পারা যায়। পশুপালনের সুবিধা অনেক। প্রথম প্রয়োজন মত তাদের নির্বাচিত করে বধ করে তাদের মাংস খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করে যায়। দ্বিতীয়ত ভেড়া ও ছাগলের লোম হতে যে পশম পাওয়া যায়, তা হতে বস্ত্র বয়ন করা যায়। তাদের দোহন করা দুধও খাদ্য হিসাবে খাওয়া যায়। এইভাবে এক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে মানুষ খাদ্য সংগ্রহকারী জীব হতে খাদ্য উৎপাদনকারী জীবে পরিণত হল।
এই যুগের বিপ্লবের ফলশ্রুতি হিসাবে মানুষ আরও কতকগুলি নূতন বিদ্যা আয়ত্ত করেছিল। সেগুলিরও একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ এখানে দেওয়া যেতে পারে।
চাষের জন্য মাটি খোঁড়ার দরকার হয়। এই প্রসঙ্গে কোদালের উদ্ভাবন হল। সেকালের কোদালে ধাতু ব্যবহার করা হত না। একখন্ড পাথরের এক দিক ঘষে সরু করে ধার করা হত। তারপর তাকে কাঠের হাতলের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হত। কোথাও পাথরের মধ্যে গর্ত করে কাঠখন্ড অনুপ্রবিষ্ট করা হত। কোথাও কাঠের সঙ্গে পাথরখন্ড বেঁধে দেওয়া হত। সম্ভবত চামড়ার দড়ি দিয়ে বা জন্তুর অস্ত্র দিয়ে বেঁধে দেওয়া হত। কোনও কোনও কোদালে যে পাথর ব্যবহার হত তার দুই মুখই ঘষে পাতলা এবং সরু করা হত।
উৎপাদিত শস্যকে সংরক্ষিত করার জন্য পাত্রের প্রয়োজন। এই সূত্রেই এই নূতন প্রস্তর যুগে মানুষ মৃতপাত্র উদ্ভাবন করতে শিখেছিল। এটি নিশ্চিত একটি বড় পদক্ষেপ। প্রথমে মাটিকে নরম করে ভিজিয়ে তাকে ইচ্ছামত পাত্রে রুপান্তরিত করে তারপর শুকিয়ে নিতে হয়েছিল। তারপর তাকে অন্তত ৬০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড উত্তাপে পুড়িয়ে নিতে হয়েছিল। প্রথম দিকে আংটির আকারে মাটিকে রূপ দিয়ে একটির পর একটি আংটি জুড়ে পাত্রটি গড়ে তোলা হত। পরে চক্র উদ্ভাবন হবার পর কাজ অনেক সোজা হয়ে যায়।
প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানুষ চামড়ার আচ্ছাদন ব্যবহার করত। নূতন প্রস্তর যুগে মানুষ বস্ত্র বয়ন করতে শিখল। সেকালের শনের আঁশ দিয়ে সূতো তৈরী হত এবং সেই সূতো দিয়ে বস্ত্র বয়ন করা হত। উত্তর মিশরে ফায়ুম হ্রদের ধারে যে নূতন প্রস্তর যুগের মানুষ বাস করত তারা শনের বস্ত্র উৎপাদন করত। উল দিয়েও বস্ত্র বয়ন করা হত। তুলা দিয়ে বস্ত্র বয়ন করা বোধ হয় পরে এসেছিল। খৃষ্টপূর্ব ৩০০০ বছরের অব্যবহিত পরেই সিন্ধু উপত্যকায় তুলার চাষ যে হত তার প্রমাণ পাওয়া যায় (Gordon Childe, Man Makes Himself P. 94)।
এর অর্থ হল সে যুগের মানুষ দুটি বিষয়ে কৌশল অর্জন করেছল। প্রথমত সূতো কাটতে এবং দ্বিতীয়ত বস্ত্র বয়ন করতে। সূতো কাটতে সম্ভবত টাকুর মত (Spindle) বস্ত্র ব্যবহার হত। বয়ন করতে নিশ্চয় তাঁতের ধরনের একটি যন্ত্র উদ্ভাবিত হয়েছিল। এটিও প্রগতির পথে একটি বড় পদক্ষেপ।
এই যুগের বৈশিষ্ট্য হল তখন নানা ধরনের কর্ম উদ্ভাবিত হলেও কোন বিশেষ শ্রেণীর ওপর কোন বিশেষ কর্তব্য ন্যস্ত হয়নি। প্রতি পরিবার এবং প্রতিগোষ্ঠী এ বিষয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। তারা নিজেরাই শস্য উৎপাদন করত, নিজেরাই পশু পালন করত, নিজেরাই মাটির পাত্র তৈরী করত এবং নিজেরাই বস্ত্র বয়ন করত। সম্ভবত মেয়েদের ও পুরুষদের মধ্যে কাজের একটা বিভাগ ছিল। সমস্ত স্তরের উচ্চ সংস্কৃতির সম্পর্ক বর্জিত আধুনিক মানুষের মধ্যে দেখা যায়, মেয়েরা চাষ করে, মৃৎপাত্র বানায়, সূতো কাটে এবং বস্ত্র বয়ন করে; অপর পক্ষে পুরুষেরা আশ্রিত পশুদের দেখাশোনা করে, জমিকে চাষের উপযুক্ত করে এবং যন্ত্রদি বানায়।
প্রাগৈতিহাসিক মানুষের জীবনে সর্বক্ষেত্রেই যে একই সময়ে এই বিপ্লব এসেছিল তা নয়। কোথাও আগে এসেছিল; কোথাও অনেক পরে এসেছিল। গর্ডন চাইল্ড-এর ধারণায় সর্বপ্রথম এই বিপ্লব এসেছিল খৃষ্টপূর্ব ৮০০০ হইতে ১০০০০ বছরের মধ্যে।
নূতন প্রস্তর যুগের শেষে মানুষ আরও কতকগুলি কৌশল আয়ত্ত করেছিল, যা একটি নূতন বিপ্লবের পথ প্রস্তুত করে দিয়েছিল। এই নূতন উদ্ভাবনগুলির আবির্ভাব সময় খৃষ্টপূর্ব ৬০০০ হইতে ৩০০০ অব্দের মধ্যে। তারা হল প্রাকৃতিক শক্তি বা পশুশক্তির ব্যবহার, লাঙল আবিস্কার, চাকাওয়ালা গাড়ী আবিস্কার, ধাতু সন্বন্ধে জ্ঞান এবং তাকে ভিত্তি করে তামা গলিয়ে, তা দিয়ে অস্ত্রাদি নির্মাণের কৌশল এবং ইট নির্মাণের কৌশল। এগুলি সম্ভব হয়েছিল যেখানে কৃষির পক্ষে প্রাকৃতিক অবস্থা স্থায়ীভাবে অনুকূল ছিল। প্রথমে চাষ হত কোদালের সাহায্যে মানুষের হাতের শক্তি দিয়ে। তার ক্ষমতা সীমিত। তাছাড়া ভূমির উর্বরতা ক্ষয় হয়ে গেলে নূতন জমিতে চাষ করতে হত। স্থায়ীভাবে বসতি করতে এবং বিস্তৃত ক্ষেত্রে শস্য উৎপাদন করতে এমন জায়গার প্রয়োজন যেখানে প্রকৃতির আনুকূল্যে ভূমির উর্বরতা আপনি সম্পাদিত হয়। সেটা সম্ভব বড় বড় নদী উপত্যকায় যেখানে বর্ষার জলে স্ফীত হয়ে নদী দুইকূল প্লাবিত করে ভূমিকে নূতন করে উর্বর করে দিতে পারবে। তাই দেখি, এই ধরনের নূতন উদ্ভাবনগুলি নীল উপত্যকায়, তাইগ্রীস ও ইউফ্রেটিস নদীর উপত্যকা, সুমেরু অঞ্চলে এবং ভারতে সিন্ধু উপত্যকাকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। আদি উচ্চমানের মানব সংস্কৃতির এই কারণেই এই স্থানগুলি লালন ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
এই যুগে মানুষ নৌকাতে পাল তুলে বাতাসকে নিজের কাজে লাগিয়েছিল। এটি একটি তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ। কারণ এই পথেই অগ্রসর হয়ে বর্তমান যুগের মানুষ প্রাকৃতিক শক্তিকে ব্যবহার করে তার বিরাট প্রযুক্তি বিদ্যা গড়ে তুলেছে।
বলদ বা গাধাকেও মানুষ এই যুগে নিজের কাজে ব্যবহার করতে শিখেছিল। গাধা হয়েছিল ভার বহনের প্রধান অবলম্বন। সঙ্গে সঙ্গে লাঙল উদ্ভাবিত হওয়ায় ভূমি কর্ষণের শক্তি মানুষের অনেক পরিমাণে বেড়ে গিয়েছিল। কোদালের সীমিত শক্তিতে যে পরিমাণ ভূমি কর্ষণ করা যায় বলদ দিয়ে লাঙল চালিয়ে তার থেকে অনেক বেশী পরিমাণ ভুমি চাষ করা যায়। অতিরিক্তভাবে বন্যার জলে প্লাবিত অঞ্চলে উর্বরতা হ্রাস পাবার সম্ভাবনা না থাকায় একই ভূখন্ড বছরের পর বছর চাষ করা সম্ভব হয়েছিল। এটাও অনুমান করা যায় এখন হতে ভূমি কর্ষণের কাজ পুরুষের উপর ন্যস্ত হয়েছিল।
চাকা উদ্ভাবনও একটি বিস্ময়কর আবিস্কার। ঠিক বলতে কি বর্তমান যুগের সংস্কৃতি চাকার ওপর নির্ভর করে চলে। চাকা না থাকলে রেলগাড়ী চলত না, মোটর গাড়ী চলত না, এয়ারোপ্লেন চলত না। চলাচল এবং পরিবহণ একেবারে অসম্ভব হয়ে পড়ত। প্রথম যে চাকা নির্মিত হত তা নিশ্চিত কাঠ দিয়ে তৈরী হত। সুতরাং সেকালের চাকা বহুকাল আগে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। তবে প্রাচীনকালে পাথরে বা মৃৎপাত্রের গায়ে খোদিত চাকাওয়ালা গাড়ীর চিত্র পাওয়া যায় এবং তা হতে অনুমান করা যায় কতকাল পূর্বে গাড়ীগুলির অস্তিত্ব ছিল। অর্থাৎ যার ওপর খোদিত হয়েছে তার বয়সকে ভিত্তি করেই এ বিষয় চক্রবিশিষ্ট যানের উদ্ভাবনের কাল অনুমান করা যায়। তা হতে দেখা যায়, সুমেরু (Sumeria) অঞ্চলে খৃষ্টপূর্ব ৩০০০ অব্দে চাকা-বিশিষ্ট যানের আবির্ভাব হয়। খৃষ্টপূর্ব ২৫০০ শতাব্দীতে গো-যান এবং রথ সিরিয়া এবং মেসোপটমিয়াতে ব্যবহৃত হত। খৃষ্টপূর্ব ২৫০০ শতাব্দীতে যে সিন্ধু-উপত্যকায় চাকা বিশিষ্ট যানের ব্যবহার ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
এই যুগে গাধা ও গরুর মত ঘোড়াও পোষ মানান হয়েছিল। সম্ভবত গোড়ায় ঘোড়া ব্যবহার হত তার দুধের জন্য বা যান টানার জন্য। রথ টানতে নিশ্চয় ঘোড়া ব্যবহার হত। সুমেরু অঞ্চলে খৃষ্টপূর্ব ২০০০ শতাব্দীতে ঘোড়া ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। সেখান হতে আরও পরে তা মিশরে আমদানী করা হয়। আরোহণের জন্য ঘোড়ার ব্যবহারের নিশ্চিত প্রমাণ খৃষ্টপূর্ব ১০০০ শতাব্দীর আগে পাওয়া যায় না।এই যুগে গাধা ও গরুর মত ঘোড়াও পোষ মানান হয়েছিল। সম্ভবত গোড়ায় ঘোড়া ব্যবহার হত তার দুধের জন্য বা যান টানার জন্য। রথ টানতে নিশ্চয় ঘোড়া ব্যবহার হত। সুমেরু অঞ্চলে খৃষ্টপূর্ব ২০০০ শতাব্দীতে ঘোড়া ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। সেখান হতে আরও পরে তা মিশরে আমদানী করা হয়। আরোহণের জন্য ঘোড়ার ব্যবহারের নিশ্চিত প্রমাণ খৃষ্টপূর্ব ১০০০ শতাব্দীর আগে পাওয়া যায় না।
অনুরূপভাবে জলে পরিবহণের ব্যবস্থারও উন্নতি হয়েছিল। প্রথমে ডোঙা ও চামড়ার নৌকার ব্যবহার প্রচলিত হয়। মিশরে প্যাপিরাসের ভেলা ব্যবহার করা হত। মিশরের প্রাগৈতিহাসিক মৃৎপাত্রের গায়ে তার চিত্র পাওয়া যায়। তারপর পালতোলা কাঠের তৈরী নৌকার আবির্ভাব হয়। খৃষ্টপূর্ব ৩০০০ শতাব্দীতে ভূমধ্য সাগরে এবং সম্ভবত আরব সাগরে পালতোলা জাহাজ যে চলাফেরা করত তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
কৃষির সমস্যার সমাধানের জন্য মানুষ প্রথম পঞ্জিকা আবিস্কার করে। সমস্যাটি ছিল বিশেষ করে মিশরের। সেখানে প্রতি বছর দক্ষিণে আবিসিনিয়া অঞ্চলের পাহাড়ে যে বর্ষা নামত তাই উত্তরে এসে মিশর অঞ্চলে নদীর দুপাশে প্লাবন সৃষ্টি করত। এই প্লাবনের পরে কৃষিকার্য আরম্ভ হত। কিন্তু কৃষিকার্য চালাতে আগে হতে প্রস্তুতি দরকার। সেইজন্য জানা দরকার ঠিক কখন প্লাবন আসবে। এই সমস্যার সমাধানের চেষ্টা হতেই মিশরবাসী পঞ্জিকা আবিস্কার করে বসল। পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেল যে, যখন নীল নদীতে বন্যা আসে তখন পূর্ব আকাশে সুর্যোদয়ের ঠিক পুর্বে যে তারা দেখা যায় তা হল লুব্ধক (Sirius) নক্ষত্র। কয়েক বছর হিসাব করে দেখা গেল এই লুব্ধক নক্ষত্র আকাশে শেষ তারা হয়ে দেখা দেয় ৩৬৫ দিন পরে। সুতরাং ৩৬৫ দিনে যে একবছর হয় এই তথ্য আবিস্কৃত হল। কেউ বলেন এই পঞ্জিকা উদ্ভাবিত হয়েছিল ৪২৩৬ খৃষ্টপূর্ব অব্দে; কেহ বলেন ২৭৭৬ খৃষ্টপূর্ব অব্দে।
এই সব নূতন আবিস্কার ও উদ্ভাবনের ফলে এমন একটি নূতন পরিবেশ সৃষ্টি হল যে আর একটি নূতন বিপ্লব এসে গেল। এতদিন প্রত্যেক গোষ্ঠী বা পরিবার আত্মকেন্দ্রিক এবং স্বয়ংনির্ভর ছিল। এখন আর তা সম্ভব হল না। এত ধরনের নূতন জীবিকা সৃষ্টি হয়েছে যে একই মানুষ সব শিক্ষা করে উঠতে পারত না। যে চাষ করত যে চাষ নিয়ে থাকল; যে পশুপালন করত সে পশু পালনে আত্মনিয়োগ করল। না না কারিগর শ্রেণী এল। কেউ নৌকা বানায়, কেউ রথ বানায়, কেউ বস্ত্র বয়ন করে, কেউ যন্ত্রপাতি তৈরী করে, কেউ মৃৎপাত্র নির্মাণ করে। এইভাবে শ্রমের প্রকারভেদে বিভিন্ন জীবিকা গড়ে উঠল। কাজেই সমাজের পুরাতন শ্রমের বিন্যাস আর বজায় রইল না। জীবিকা অনুসারে পেশা ভিন্ন ভিন্ন প্রকার হয়ে উঠল।
ফলে জনসংখ্যা বাড়ল। এক নূতন শাসক সমাজ এল। তারা সংখ্যায় অল্প হলেও তাদের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হল। তারা কৃষকদের নিকট কর আদায় করতে লাগল। শহর গড়ে উঠল। দেশে অনেক নগর স্থাপিত হল। মিশরে রাজ্যশাসন চালিত হল রাজার তত্ত্বাবধানে। সুমেরু দেশে রাজ্য শাসনের দায়িত্ব এল পুরোহিত সম্প্রদায়ের ওপর। তারা দেবতার অছি নিযুক্ত হয়ে রাজ্য শাসন করত, কর আদায় করত।
এখন আর শুধু সাধারণ গৃহস্থের জন্যে ছোট গৃহ নির্মাণ হয় না। রাজপুরুষদের জন্য প্রাসাদ নির্মিত হল। সুমেরু দেশে দেবতার জন্য বিরাট মন্দির গড়া হল। তা যে কৃত্রিম পাহাড়ের উপর স্থাপিত হল তার নাম হল জিগ্গারাট (Ziggurat)। মিশরে রাজাকে কবর দেবার জন্য বিরাট পিরামিড নির্মাণ হল। এইভাবে সমাজের রূপ একেবারে পরিবর্তিত হয়ে গেল। একেই দ্বিতীয় বিপ্লব বলা হয়।
এইভাবে খৃষ্টপূর্ব ৩০০০ শতাব্দীতে নগরভিত্তিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠায় মানব সংস্কৃতির রূপ একেবারে পরিবর্তিত হয়ে গেল। এই পরিবর্তন মিশর দেশ, সুমেরু এবং সিন্ধু উপত্যকায় মোটামুটি একই সময়ে সংঘটিত হয়েছিল। ছোট ছোট কৃষকের খামার আর তখন সমাজ বিন্যাসের উপাদান রইল না; সমাজ বিন্যাস বেশ জটিল আকার ধারণ করল। রাষ্ট্র এল সবার উপরে। তার তত্ত্বাবধানে রইল নানা শ্রেণী। তাদের কেউ প্রাথমিক উৎপাদক, কেউ নয়। সমাজে শ্রেণীভেদ এল। প্রথম শ্রেণীতে স্থান পেল রাজ পরিবারের মানুষ, পুরোহিত, মশীজীবী এবং রাজপুরুষ। তারপর স্থান পেল বিভিন্ন শ্রেণীর কারিগর, পেশাদার সৈন্য এবং শ্রমিক। সবার নিম্নস্তরে অর্থনৈতিক বিন্যাসের ভিত্তি হিসাবে রইল কৃষিজীবী। এই সব অঞ্চলের মাটি খুঁড়ে প্রত্নতাত্ত্বিক কৃষির যন্ত্র এবং গৃহে উৎপাদিত ব্যবহার্য দ্রব্য পেল না। পরিবর্তে পেল আসবাব-পত্র, অস্ত্র, উন্নত ধরনের মৃৎপাত্র, অলংকার এবং নানা বিলাস দ্রব্য। গৃহস্থের গৃহের ভগ্নাবশেষের পরিবর্তে প্রত্নতাত্ত্বিক পেল স্মৃতিমন্দির, দেবমন্দির, প্রাসাদ এবং কারখানার ভগ্নাবশেষ।
এই সংস্কৃতি ছিল নগর ভিত্তিক সংস্কৃতি। মিশর, সুমেরু ও সিন্ধু উপত্যকায় মোটামুটি একই ধরনের এই নগরভিত্তিক নূতন সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল। এই দেশগুলির মধ্যে বাণিজ্যের আদানপ্রদান ছিল। অবশ্য বিভিন্ন দেশে উৎপাদিত পণ্যদ্রব্যের মধ্যে স্থানগত বিভিন্নতা ছিল। তবে তা মৌলিক নয়। মোটামুটি একই ধরনের পণ্য উৎপাদিত হত। অর্থাৎ তারা সকলেই একই প্রযুক্তি বিদ্যা আয়ত্ত করতে পেরেছিল।
তিনটি দেশেই সংস্কৃতির বেশ উচ্চমানে আরোহণ করেছিল। তবে বর্তমান প্রসঙ্গে মিশর ও সুমেরীয় সংস্কৃতির বিস্তারিত বিবরণ দেবার প্রয়োজন দেখা যায় না। সিন্ধু উপত্যকার সংস্কৃতির সহিত বরং আমাদের একটু পরিচিত হওয়া প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে।
দুর্ভাগ্যক্রমে মিশরীয় ও সুমেরীয় সংস্কৃতি সন্বন্ধে যেমন বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে, সিন্ধু উপত্যকার সংস্কৃতি সন্বন্ধে তেমন পাওয়া যায় নি। আমরা জানতে পারি খৃষ্টপূর্ব ২৫০০ শতাব্দীর এই নগরভিত্তিক সংস্কৃতি ভারতের উত্তর পশ্চিম অঞ্চলে এক বিস্তৃত ভূখন্ডে ছড়িয়ে পড়েছিল। পাঞ্জাব হতে সিন্ধু নদীর মোহনা পর্যন্ত এবং পশ্চিমে পাহাড়ের কোল পর্যন্ত এই নগরভিত্তিক সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু এই সমগ্র অঞ্চলে একই শাসকগোষ্ঠীর অধীন ছিল কিনা জানা যায় না। প্রধান অন্তরায় অন্য জায়গার যেমন লিখিত আকারে অনেক তথ্য সংগৃহীত ছিল, এখানে প্রত্নতাত্ত্বিক তেমন কিছু পাননি। প্রত্নতাত্ত্বিক আবিস্কারের মধ্যে লেখা পাওয়া গেছে; কিন্তু এখনও তার পাঠ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। সম্ভব হলে কিছু আলোকপাত হত; কিন্তু তা হতে এখনও আমরা বঞ্চিত আছি। তা সত্ত্বেও হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোতে যে প্রত্নতাত্ত্বিক দ্রব্য পাওয়া গেছে তা হতে ধারণা করে যায়, এ অঞ্চলে এক উচ্চমানের নগরভিত্তিক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল।
মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পা খুঁড়ে যে সব প্রত্নতাত্ত্বিক দ্রব্য আবিস্কৃত হয়েছে তা একটি উন্নত নগরভিত্তিক সংস্কৃতির পরিচয় দেয়। মহেঞ্জোদারো সিন্ধুনদের ডান দিকে সিন্ধু প্রদেশে স্থাপিত। হরপ্পা রাভি নদীর বাম দিজে পাঞ্জাবে অবস্থিত। হরপ্পা সংস্কৃতি এই দুটি নগরকে কেন্দ্র করে তাদের আশেপাশে গড়ে উঠেছিল। তাদের সংস্কৃতির মানের উচ্চতা সন্বন্ধে ধারণা করবার জন্য সেখানে আবিস্কৃত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের ভিত্তিতে যে তথ্য পাওয়া গেছে তার একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয় নীচে দেওয়া হল।
শহর দুটি চতুর্ভুজ আকারে নির্মিত। মাঝখানে একটি দুর্গের মত অট্টালিকা একটি উচ্চ বেদীর উপর স্থাপিত ছিল। তার উপরের অংশে কতকগুলি গৃহ ছিল। মনে হয় সেগুলি কোনও আনুষ্ঠানিক কাজের জন্য ব্যবহৃত হত। তার আশেপাশে ছিল রাস্তা। সেই রাস্তার দুধারে সারি সারি বাড়ী ছিল। তার বাইরে ছিল শ্রমিক শ্রেণীর ঘর। তারা নানা শিল্পে কাজ করত।
এই সংস্কৃতি সন্বন্ধে স্টুয়ার্ট পিগোট তাঁর গ্রন্থে এইরূপ লিখেছেনঃ(পৃঃ ১৫৩)
হরপ্পার সংস্কৃতির যে প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য পাওয়া যায় তার থেকে যুক্তিসম্মতভাবে এই সিদ্ধান্ত করা যায় যে, এটি এমন একটি রাজ্য ছিল যা চুড়ান্ত ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাজ্য কর্তৃক শাসিত হত। তারা পুরোহিত শ্রেণী হতে নির্বাচিত হত। তারা দুটি কেন্দ্র হতে শাসনকার্য পরিচালনা করত এবং একটি বড় নাব্য নদী মুল সংযোগ সুত্রের কার্য সম্পাদন করত। এই দুটি নগর এবং খানিক পরিমাণে ছোট ঘরগুলির অধিবাসীদের ভরণপোষণের জন্য এবং তাদের খাদ্যশস্য সরবরাহের জন্য দ্বৃত্ত শস্য উৎপাদনের উপযুক্ত নিশ্চয় একটি সুবিন্যস্ত শস্য উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। প্রমাণ পাওয়া যায় গম এবং যব উৎপন্ন হত। মটরসুঁটি ও রাই উৎপাদনের প্রমাণ পাওয়া যায়। এরা যে তুলা উৎপাদন করত মহেঞ্জোদারোতে তার প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে।
হরপ্পার সংস্কৃতির যে প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য পাওয়া যায় তার থেকে যুক্তিসম্মতভাবে এই সিদ্ধান্ত করা যায় যে, এটি এমন একটি রাজ্য ছিল যা চুড়ান্ত ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাজ্য কর্তৃক শাসিত হত। তারা পুরোহিত শ্রেণী হতে নির্বাচিত হত। তারা দুটি কেন্দ্র হতে শাসনকার্য পরিচালনা করত এবং একটি বড় নাব্য নদী মুল সংযোগ সুত্রের কার্য সম্পাদন করত। এই দুটি নগর এবং খানিক পরিমাণে ছোট ঘরগুলির অধিবাসীদের ভরণপোষণের জন্য এবং তাদের খাদ্যশস্য সরবরাহের জন্য দ্বৃত্ত শস্য উৎপাদনের উপযুক্ত নিশ্চয় একটি সুবিন্যস্ত শস্য উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। প্রমাণ পাওয়া যায় গম এবং যব উৎপন্ন হত। মটরসুঁটি ও রাই উৎপাদনের প্রমাণ পাওয়া যায়। এরা যে তুলা উৎপাদন করত মহেঞ্জোদারোতে তার প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে।
যে সব পশু পালিত হত তাদের মথ্যে কুঁজযুক্ত ষাঁড় অন্যতম। এ ছাড়া মহিষ, ছাগল, ভেড়া, শূয়র গৃহপালিত পশু হিসাবে পালিত হত। কুকুরও যে পালিত হত তার প্রমাণ পাওয়া যায়। হরপ্পায় যে অস্থি পাওয়া গেছে তা হতে প্রমাণ হয় দু শ্রেণীর কুকুর পালিত হত। একটি ছিল বর্তমানে যে দেশী শ্রেণীর কুকুর পাওয়া যায় তাই এবং অপরটি আকারে বড় ম্যাসটিফ (mastiff) শ্রেণীর ছিল। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোতে উটের হাড়ও পাওয়া গেছে। সুতরাং অনুমান করে যায় উট পোষা হত। গাধা ও ঘোড়া পোষা হত। এমন কি হাতীও যে পোষা হত তারও প্রমাণ পাওয়া যায়।
মহেঞ্জোদারো নগরটির কিছু বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করার প্রয়োজন আছে। তার বিস্তার ছিল এক বর্গমাইল জুড়ে। প্রাগৈতিহাসিক যুগের পক্ষে সেটি একটি বড় শহর ছিল স্বীকার করতে হবে। এখানে ৪০ ফুট দীর্ঘ এবং ২৪ ফুট প্রস্থ এবং ৮ ফুট গভীর ইট দিয়ে বাঁধানো একটি জলাধার পাওয়া গেছে। সম্ভবত এটি স্নানের জন্য ব্যবহৃত হত। আর একটি খুব বড় অট্টালিকা পাওয়া গেছে। তা দৈর্ঘ্যে ২৩০ ফুট এবং প্রস্থে ৭৮ ফুট; মাঝে একটি প্রাঙ্গণ। প্রত্নতাত্ত্বিকরা অনুমান করেন এটি সম্ভবত একটি শিক্ষণ প্রতিষ্ঠান ছিল।
পরিবহণের জন্য বলদের গাড়ী ব্যবহার হত। তার মাটিতে তৈরী নিদর্শন হরপ্পা সংস্কৃতির বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে সর্বত্রই পাওয়া যায়। নদীতে নৌকা পরিবহন হত। তবে তার নিদর্শন মাত্র দুটি পাওয়া গেছে – একটি মৃতপাত্রের ভগ্ন অংশে এবং অন্যটি একটি শীলমোহরে। এক্কা গাড়ীর মত এক রকম গাড়ীও তখন ব্যবহার হত। সম্ভবত তা বলদে টানত। এর দুটি নিদর্শন পাওয়া গেছে। একটি হরপ্পায়, অন্যটি চানহুদারোতে। দুর্ভাগ্যক্রমে যে জন্তু জোতা ছিল তা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। মহেঞ্জোদারোতে এই উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত দুটি ব্রোঞ্জ-এর বলদ পাওয়া গিয়েছে। তা হতে অনুমান করা যায় এই ধরনের এক্কাগাড়ী বলদে টানত।
হরপ্পা সংস্কৃতিতে লেখার রীতি উদ্ভাবিত হয়েছিল। সাধারণত এই লেখার নিদর্শন শীলমোহরে পাওয়া যায়। কিছু কিছু লেখা মৃৎপাত্রও পাওয়া যায়। অন্য কোন প্রাগৈতিহাসিক বর্ণমালার সঙ্গে এর সাদৃশ্য পাওয়া যায় না। হিসাব করে দেখা গেছে মোট ৪০০টি অক্ষর ব্যবহার হত। একই অক্ষরের পরিবর্তিত রূপ বাদ দিলে মোট অক্ষরের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৫০। দুর্ভাগ্যক্রমে এই লেখাগুলির পাঠ উদ্ধার এখনও সম্ভব হয়নি। তা হলে এই সংস্কৃতি সন্বন্ধে নূতন আলোকপাতের সম্ভাবনা আছে।
পণ্যদ্রব্য ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য বাটখারার প্রচলন ছিল। বাটখারার ওজনগুলি নিঁখুতভাবে সমান রাখা হত। বড় মাপের বাটখারা পণ্যদ্রব্য ওজনের জন্য রাখা হত। ছোট মাপের বাটখারা অলংকার এবং পুঁথি ওজনের জন্য ব্যবহৃত হত। মহেঞ্জোদারোতে পুঁথির দোকানে অনেক ছোট ওজনের বাটখারা পাওয়া গেছে।
দৈর্ঘ্য পরিমাপের জন্যও মাপকাঠি ব্যবহার হত। দুটি স্বতন্ত্র ধরনের মাপকাঠি পাওয়া গিয়াছে। মহেঞ্জোদারোতে একটি মাপকাঠি পাওয়া গিয়াছে। তার দৈর্ঘ্য ১৩.২ ইঞ্চি। হরপ্পায় একটি ব্রোঞ্জের নির্মিত মাপকাঠি পাওয়া গেছে। তার দৈর্ঘ্য ২০।।৬২ ইঞ্চি। মনে হয় দুইর ধরনের মাপকাঠিই একসঙ্গে ব্যবহৃত হত।
হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোতে অনেক অলংকারও আবিস্কৃত হয়েছে। সোনার গহনা পুঁথি এবং নানা মূল্যবান পাথরের অলংকারও ব্যবহার হত। সবুজ বর্ণের পাথর (Jade) এবং নীলকান্তমণির (Lapis lasuli) অলংকার ব্যবহৃত হত। সোনার ফলক (plaque), সোনার আর্মলেট (Armlet), সোনার শঙ্কু (Conical ornament) কানের মাকড়ি, গলার হার, কোমরের মেখলা – এইসব শ্রেণীর নানা অলংকার আবিস্কৃত হয়েছে।
এই সংস্কৃতিতে তামার বা তামা ও টিন মিশ্রিত ধাতু দিয়ে গড়া ধাতুর অস্ত্র প্রভৃতি ব্যবহৃত হত। অস্ত্রগুলি নির্মিত হত দুই রীতিতে – ঢালাই করে (casting) এবং পিটিয়ে (forging)। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসাবে কুঠার ও বর্শার ফলক, বঁড়শি, আয়না ইত্যাদি পাওয়া গেছে।
যে মানুষেরা প্রাচীনকালে এই উচ্চমানের সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিল তারা কোন গোষ্ঠীর মানুষ ছিল সে বিষয় কিছু তথ্য পাওয়া যায়। পিগোট বলেন যে সমস্ত কঙ্কাল পাওয়া গেছে তাদের খুলির হাড় দেখে অনুমান করা যায় যে তারা প্রধানত আদি অস্ট্রেলিয় (Proto-Austroloid) শ্রেণীর ছিল। এদের ললাট অনুন্নত এবং নাসিকা অনতিপ্রশস্ত। ডঃ বিরজাশঙ্কর গুহ এদের প্রথমে অস্ট্রেলিয় বলে স্বীকার করে পরে ককেশীয় জাতি বলে মত প্রকাশ করেছেন। আর একশ্রেণীর করোটি পাওয়া যায় যা বর্তমান ভারতের আদিম অধিবাসীদের অনুরূপ মানুষের পরিচয় দেয়। আর একশ্রেণীর কঙ্কাল পাওয়া যায় যা ইঙ্গিত করে এদের মস্তক লম্বা ছিল, নাসিকা অপ্রশস্ত। ফ্রিডরিকস (Friedericks) ও মূলার (Muller) -এর ধারণায় তারা আদি আর্মিনিয় (Armenoid)। মনে হয় বেশীর ভাগ অধিবাসী আদি-অস্ট্রেলিয় শ্রেণীর ছিল।
সিন্ধু উপত্যকার এই মানুষগুলি প্রায় হাজার শতাব্দী ধরে তাদের উচ্চসংস্কৃতি অক্ষুণ্ন রেখে বাস করেছিল। তারপর প্রমাণ পাওয়া যায় আনুমানিক খৃষ্টপূর্ব পঞ্চদশ শতাব্দীতে পশ্চিম হতে এক নূতন জাতি আসে তাঁদের পর্যুদস্ত করেছিল। অনুমান করা হয় এরাই হল বৈদিক সংস্কৃতির বাহক আর্যজাতি। এখন প্রশ্ন হল এই আর্যজাতি কোথা হতে এল। মনে হয় তুলনামুলক ভাষাতত্ত্বের সাহায্যে তার একটা সমাধান করা যায়।
১৭৬৭ খৃষ্টাব্দে কুর্দু (Courdoux) লক্ষ্য করেন যে সংস্কৃত ভাষার সঙ্গে গ্রীক ও লাতিন ভাষার বেশ সাদৃশ্য দেখা যায়। স্যর উইলিয়ম জোনস একজন বিখ্যাত সংস্কৃতের পন্ডিত ছিলেন। তিনি প্রথম ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম্’ গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ করেন। এই সাদৃশ্যও তাঁরও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই সাদৃশ্য হতে তাঁরা অনুমান করেন যে এই ভাষাগুলি একটি প্রাচীনতর ভাষা হতে উৎপন্ন হয়েছে। ১৮৩১ খৃষ্টাব্দে বপ (Bopp) এ বিষয় গবেষণা করে একটি স্থির সিদ্ধান্তে আসেন যে এই অনুমানের সপক্ষে প্রবল যুক্তি আছে। তিনি এই ভাষাগুলিকে ভারত-ইয়োরোপীয় (Indo-European) গোষ্ঠীর ভাষা বলে নামকরণ করেন।
এই ভাষাগুলিতে মৌলিক শব্দগুলির (যেমন পারিবারিক সন্বন্ধসূচক এবং সংখ্যাসূচক শব্দ) মধ্যে পরস্পর আশ্চর্য রকম সাদৃশ্য লক্ষিত হয়। যেমন সংস্কৃত পিতৃ শব্দ লাতিন পাটের (Pater) হয়ে গেছে, ইংরাজি (Father), জার্মান ভাষার ফাটের (Vater) এবং ফরাসীতে প্যার (Pere)। সংস্কৃত শতম্ লাতিন ভাষায় সেন্টাম (Centum)। সংস্কৃত ত্রি ইংরেজীতে থ্রি (Three) জার্মান ভাষায় ড্রাই (drei), ফরাসীতে ত্রোয়া (Trois) ইত্যাদি। এইসব সাদৃশ্য হতে এই রকম অনুমান করা হয় যে এইসব ভাষাভাষীদের এক সাধারণ পূর্বপুরুষ ছিল এবং তারা একই ভাষায় কথা বলত। পরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপে তারা যখন বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ল তাদের ভাষা পরিবর্তিত হয়ে পরস্পর হতে বিভিন্ন হয়ে গেল। অনুমান করা হয় যে, এই পূর্বপুরুষের গোষ্ঠী কৃষিজীবী ছিল, তারা ঘোড়াকে পোষ মানিয়েছিল এবং তামা এবং ব্রোঞ্জের ব্যবহার জানত এবং মানুষের আদর্শে কল্পিত (anthropomorphic) দেবতাদের পুজা করত। উদাহরণস্বরূপ বৈদিক যুগে বর্ণিত অশ্বমেধ যজ্ঞের মত অনুষ্ঠান আলতাই টার্কদের মধ্যে এখনও প্রচলিত আছে এবং আয়ার্ল্যান্ডে খৃষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত প্রচলিত ছিল।
এখন প্রশ্ন হল এই আদিম জাতির বাসভূমি কোথায় ছিল। এই নিয়ে প্রচুর মতদ্বৈধ আছে। জার্মান পন্ডিত কোসিনা (Kosinna) প্রতিপাদিত করতে চেষ্টা করেছিলেন যে, তাদের আদি বাসভুমি ছিল উত্তর ইওরোপীয় উপত্যকায়। ভারতীয় গবেষক বাল গঙ্গাধর তিলক প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছেন যে প্রাচীন আর্য জাতির বাস ছিল ৬০০০ খৃষ্টপূর্ব শতাব্দীতে উত্তর মেরু অঞ্চলে।
তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব ও প্রত্নতত্ত্ব হতে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে একটি তৃতীয় মত গড়ে উঠেছে। অধ্যাপক জে. এল. মায়ার্স (J.L. Myers), হ্যারল্ড পীক (Harold Peake) এবং চাইল্ড (Childe) এই মতটির সমর্থক। তাঁদের ধারণায় খৃষ্টপূর্ব তৃতীয় ও দ্বিতীয় সহস্রাব্দীতে এদের নিবাস ছিল দক্ষিণ রুশিয়াতে এবং তার পূর্বাঞ্চল কাম্পিয়ান সাগরের তীরে। এরা খানিকটা যাযাবর ছিল তবে কৃষিকার্য করত এবং স্থায়ী বসতিও স্থাপন করত। তারা মেষ, গরু ও অশ্ব পালন করতে শিখেছিল। তারা মৃতদের সমাধিস্থ করত।
পিগোটের ধারণায় খৃষ্টপূর্ব ২০০০ শতাব্দীর পরবর্তী শতাব্দীগুলিতে উত্তর পশ্চিম থেকে ভারত একাধিক জাতি কর্তৃক আক্রান্ত হয়েছিল। ভারত-ইয়োরোপীয় ভাষাভাষী মানুষও তাদের অন্যতম ছিল। এই সময় পারস্যের সীমানায় কাসাইট (Kasite) এবং মিটানিয়ানদের (Mittanian) স্থাপিত রাজ্য গড়ে ওঠে। তারা ভারত-ইয়োরোপীয় ভাষাভাষী গোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত ছিল।
হুইলার-এর ধারণা এই সময়ই ঋগবেদ বর্ণিত প্রাচীন আর্যজাতি উত্তর পশ্চিম ভারতে প্রবেশ করে এবং হরপ্পা সংস্কৃতির ধারক যে মনুষ্য গোষ্ঠী ছিল তাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এই সংঘর্ষে যারা অধিনায়কের ভূমিকা গ্রহণ করে তাদের আদর্শেই ঋগবেদের দেবতা ইন্দ্রের চরিত্রটি কল্পিত হয়েছে। তিনি বলেন ঋগবেদের ‘পুরন্দর’ কথাটি ইন্দ্রের উপাধি হিসাবে ব্যবহৃত। ইন্দ্র সিন্ধুনদের অববাহিকায় যে সভ্য প্রাচীন জাতিদের শহর ছিল সেইগুলি ধ্বংস করেন বলেই তাঁর নাম পুরন্দর। সিন্ধু অববাহিকাবাসীরা প্রস্তরের এবং মৃত্তিকার দুর্গ নির্মাণ করত। তাদের ধংসাবশেষ প্রত্নতত্ত্ববিদ এই অঞ্চলে সম্প্রতি অনেক আবিস্কার করছেন। ঋগবেদে ইন্দ্র এই ধরনের দুর্গ যে ধ্বংস করেছিলেন বলে বর্ণনা আছে তা এই সকল দুর্গকেই সূচিত করে। (Wheeler Indian Civilization p. 90f)
পিগোট হুইলার-এর এই প্রতিপাদ্য গ্রহণ করেছেন। (Stuart Piggot. Prehistoeric India, chap VII)। তিনি বলেন এটা সুবিদিত যে, খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দীর গোড়ার দিকে ভারতে হরাপ্পা সংস্কৃতি পূর্ণ মহিমায় অধিষ্ঠিত ছিল। তাদের সংস্কৃতি নগরকেন্দ্রিক এবং সেই নগরগুলি দুর্গ দিয়ে সুরক্ষিত ছিল। আর্যজাতি ভারতে প্রবেশ করলে তাদের সহিত যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং তাদের দুর্গগুলি ধ্বংস করে দেয়। এই ঐতিহাসিক ঘটনারই ছায়াপাত হয়েছে ঋগবেদের ইন্দ্রের বীরত্ব সূচক কীর্তির বর্ণনায়। বৈদিক সাহিত্যে যে জাতির সঙ্গে তারা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল তাদের দস্যু বা দাস বলে বর্ণনা করা হয়েছে। তাদের আকৃতি সম্পর্কে বলা হয়েছে তারা কৃষ্ণকায় এবং ‘অনাস’ অর্থাৎ তাদের নাক চ্যাপ্টা ছিল। আমরা পুর্বেই বলেছি এই প্রাচীনতর জাতির মানুষের অধিকাংশ ছিল অস্ট্রেলিয় গোষ্ঠীভুক্ত। তারা কৃষ্ণকায় ছিল এবং তাদের নাক চ্যাপ্টা ছিল।
এই প্রসঙ্গে ইন্দ্রের বীর্যসুচক ভুমিকার ঋগবেদে যে উল্লেখ আছে সে বিষয় তিনি প্রসঙ্গত আলোচনা করেছেন। যেমন ঋগবেদ প্রথম মন্ডলের ৫৩ সূক্তে আছেঃ “হে ইন্দ্র তুমি শত্রুধর্ষণকারীরূপে যুদ্ধ হতে যুদ্ধান্তরে গমন কর, বল দ্বারা নগরের পর নগর ‘ধ্বংস কর।” (রমেশচন্দ্র দত্তের অনুবাদ) দ্বিতীয় মন্ডলের ১৫ সূক্তে আছেঃ “ইন্দ্র বলকে বিদীর্ণ করেছিল, পর্বতের দৃঢ় দ্বার উদঘাটিত করেছিল; তাদের কৃত্রিম রোধ সকল উদ্ঘাটিত করেছিল।” ইন্দ্রকে যে পুরন্দর বলা হয় সে কথারও তিনি উল্লেখ করেছেন।
এই সকল তথ্য হতে অনুমান করা যায় যে খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দীর গোড়ার থেকে উত্তর-পশ্চিম হতে আর্য জাতিরা ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে প্রবেশ করে এবং সেখানে অধিষ্ঠিত যে প্রাচীনতর নগর ভিত্তিক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল তার সহিত সংঘর্ষে আসে। ঋগবেদের সূক্তগুলিতে এই সংঘর্ষের ছায়াপাত হয়েছে।
এই ভিত্তিতে ঋগবেদের রচনাকালের সমস্যার একটি মীমাংসা করে নেওয়া যায়। ঋগবেদ রচিত হয় আর্য জাতি সিন্ধু উপত্যকাবাসীদের পরাস্ত করবার পর এখানে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করবারও পরে। ভারতে প্রবেশ এবং বসতি করে ঋগবেদ রচনা শুরু করতে কয়েক শতাব্দী কাল সময় লাগবে অনায়াসে অনুমান করা যায়। এই তথ্যের ভিত্তিতে ঋগবেদের রচনাকালকে খৃষ্টপূর্ব পঞ্চদশ শতাব্দীতে ফেলা যায়।
এই প্রতিপাদ্যের সমর্থনে কিছু প্রমাণও পাওয়া যায়। একটি মিটানিয়ান নথী পাওয়া গেছে যার আনুমানিক কাল খৃষ্টপূর্ব ১৩৮০ অব্দ ধার্য করা হয়েছে। তাতে কতকগুলি ঋগবেদের দেবতার নাম উল্লিখিত হয়েছে। তা হতে পিগোট অনুমান করেন ঋগবেদের রচনাকাল খৃষ্টপূর্ব ১৪০০-১৫০০ শতাব্দীর মধ্যে। মনে হয় এই সিদ্ধান্ত যুক্তিসম্মত।
ঋগ্বেদ পরিচয় – (২) ঋগ্বেদের সঙ্গে অন্য বেদের সম্পর্ক
ঋগ্বেদের সঙ্গে অন্য বেদের সম্পর্ক
ঋক্, সাম, যজু ও অথর্ব এই চারটি বেদের সঙ্গে পরস্পর ঘনিষ্ঠ সন্বন্ধ আছে। ঋকবেদের শাকল শাখাই সমধিক প্রচলিত। তাতে দশটি মন্ডল আছে এবং প্রতি মন্ডলে অনেকগুলি সূক্ত বা দেবতার উদ্দেশ্যে রচিত প্রশস্তি আছে। এই সূক্তগুলির উপাদান হল কয়েকটি মন্ত্র। এই মন্ত্রগুলিকে ঋক্ বলে। ঋক্ সমূহের সংগ্রহ গ্রন্থ বলেই ঋগবেদের এই নাম। কোনও সূক্তে ঋক্ সংখ্যা ৪।৫টি, কোনও সূক্তে ২৫।৩০টিও আছে। কোথাও আরও বেশী আছে।
ঋগবেদের দশটি মন্ডলে মোট ১০,৫৫২টি ঋক্ নিয়ে ১,০২৮টি সূক্ত আছে। এদের মধ্যে অষ্টম মন্ডলের অন্তর্ভূক্ত ৮০টি ঋক নিয়ে ১১টি সূক্তকে বালখিল্য সূক্ত বলা হয়। সায়ণাচার্য এগুলিকে ঋগবেদের অন্তর্ভূক্ত বলে স্বীকার করেন না। সেই জন্য তাদের ওপর ভাষ্য রচনা করেন নি। তাদের বাদ দিয়ে ঋগবেদে সূক্ত সংখ্যা দাঁড়ায় ১,০১৭এই এবং ঋক্ সংখ্যা দাঁড়ায় ১০,৪৭২টি। তাদের ধরে নিয়ে বিভিন্ন মন্ডলে সূক্ত এবং ঋক্ সংখ্যা এই রকম দাঁড়ায়ঃ
প্রথম মন্ডল ১৯১ সূক্ত ২,০০৬ ঋক্
দ্বিতীয় মন্ডল ৪৩ সূক্ত ৪২৯ ঋক্
তৃতীয় মন্ডল ৬২ সূক্ত ৬১৭ ঋক্
চতুর্থ মন্ডল ৫৮ সূক্ত ৫৮৯ ঋক্
পঞ্চম মন্ডল ৮৭ সূক্ত ৭২৭ ঋক্
ষষ্ট মন্ডল ৭৫ সূক্ত ৭৬৫ ঋক্
সপ্তম মন্ডল ১০৪ সূক্ত ৮৪১ ঋক্
অষ্টম মন্ডল ১০৩ সূক্ত ১৭১৬ ঋক্
নবম মন্ডল ১১৪ সূক্ত ১১০৮ ঋক্
দশম মন্ডল ১৯১ সূক্ত ১৭৫৪ ঋক্
মোটঃ ১০২৮ সূক্ত ১০৫৫২ ঋক্
দ্বিতীয় মন্ডল ৪৩ সূক্ত ৪২৯ ঋক্
তৃতীয় মন্ডল ৬২ সূক্ত ৬১৭ ঋক্
চতুর্থ মন্ডল ৫৮ সূক্ত ৫৮৯ ঋক্
পঞ্চম মন্ডল ৮৭ সূক্ত ৭২৭ ঋক্
ষষ্ট মন্ডল ৭৫ সূক্ত ৭৬৫ ঋক্
সপ্তম মন্ডল ১০৪ সূক্ত ৮৪১ ঋক্
অষ্টম মন্ডল ১০৩ সূক্ত ১৭১৬ ঋক্
নবম মন্ডল ১১৪ সূক্ত ১১০৮ ঋক্
দশম মন্ডল ১৯১ সূক্ত ১৭৫৪ ঋক্
মোটঃ ১০২৮ সূক্ত ১০৫৫২ ঋক্
ঋক্, সাম ও যজুর্বেদের মধ্যে খুব ঘনিষ্ঠ সন্বন্ধ বিদ্যমান। আগেই বলা হয়েছে যাঁর জন্য যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হচ্ছে তিনি যজমান এবং যাঁরা যজ্ঞ কার্যটি অনুষ্ঠান করছেন তাঁরা ঋত্বিক। এই ঋত্বিকদের মধ্যে শ্রেণী বিভাগ ছিল। যিনি প্রশস্তি পাঠ করতেন তিনি হোতা। তাঁর পাঠন মন্ত্রের সংকলন ঋক্ সংহিতা। যিনি গান গেয়ে স্তুতি করেন তিনি উদ্গাতা। তাঁর গেয় মন্ত্রের সংকলন হল সাম সংহিতা। যিনি আহুতি দেন তিনি অধ্বর্যু। সেই সময় যে মন্ত্র উচ্চারণ হত তার সংকলন হল যজুঃসংহিতা। মীমাংসার মত ঋক্ ও সাম ছাড়া সব যজুঃ (মীমাংসা সূত ২।১।৩৭)। সুতরাং ঋক্ মিত’ অর্থাৎ পদবদ্ধ, সাম সুরে বাঁধা সঙ্গীত রূপে গেয়, আর যজুঃ ‘অমিত’ অর্থাৎ তা ঋকের মত ছন্দোবদ্ধ নয়। যজুর্বেদ সংহিতার মন্ত্রগুলি গদ্যে রচিত। সুতরাং ঋক্, সাম ও যজুঃ সংহিতা পরস্পর ঘনিষ্ঠ সন্বন্ধে যুক্ত। সম্ভবতঃ একই যজ্ঞে তিন সংহিতার মন্ত্রই ব্যবহার হত।
এই তিন বেদের ঘনিষ্ঠতা সন্বন্ধে আরও কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়। আমরা দেখি সামবেদের কৌথুন শাখার ১,৮১০টি ঋক্ আছে। পুনরুক্তি বাদ দিলে মোট ঋক্ সংখ্যা ১,৬০৩। তাদের মধ্যে ১৯টি বাদে সবই ঋগবেদ হতে নেওয়া। তাদের সম্ভবত ঋগবেদের অন্য শাখা হতে সংগ্রহ করা হয়েছে। এ বিষয়ে নিশ্চিত হবার উপায় নেই। কারণ ঋগবেদের অনেক শাখা বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
অনুরূপভাবে যজুর্বেদ যদিও গদ্যে রচিত, তার মধ্যেও অনেক ঋগবেদের ঋকের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। বাজসনেয় সংহিতার অর্ধেক মন্ত্র ঋগবেদ হতে নেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে অথর্ববেদের সঙ্গেও ঋগবেদের কিছু সংযোগ আছে। অথর্বেদে ছন্দোবদ্ধ মন্ত্রও আছে, গদ্যে রচিত মন্ত্রও আছে। ছন্দোবদ্ধ মন্ত্রকেও ঋক্ বলা হয়। অথর্ববেদের মোট মন্ত্র সংখ্যার এক পঞ্চমাংশ ঋগবেদ সংহিতা হতে নেওয়া।
এই সব দেখে মনে হয় ঋগবেদ চারটি বেদের মধ্যে প্রাচীনতম গ্রন্থ। এদের মধ্যে আবার ঘনিষ্ঠতার ভিত্তিতে বেদগুলিকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। ঋক্, সাম ও যজু নিয়ে পরস্পর ঘনিষ্ঠ সন্বন্ধে যুক্ত তিনটি বেদ এক দিকে এবং চতুর্থ বেদ অথর্ববেদ সংহিতা অন্য দিকে। অথর্ববেদের আবির্ভাব হয়েছিল মনে হয় এদের অনেক পরে। এই প্রতিপাদ্যের সপক্ষে কিছু প্রমাণ স্থাপন কর যায়।
প্রথমত লক্ষ্য করা যেতে পারে, অথর্ববেদের প্রকৃতি অন্য তিন বেদ হতে ভিন্ন। সেটা বুঝতে হলে অথর্ববেদের আলোচিত বিষয়ের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া প্রয়োজন।
অথর্ববেদের সূক্তগুলি কুড়িটি কান্ডে বিভক্ত। সপ্তম কান্ড পর্যন্ত নানা আভ্যুদয়িক কর্মের মন্ত্রই বেশী। এরা হল আয়ূষ্য অর্থাৎ দীর্ঘ আয়ূলাভের জন্য, ভৈষজ্য অর্থাৎ আরোগ্য লাভের জন্য, শান্তিক অর্থাৎ ভৌতিক উপদ্রবাদি দূর করবার জন্য, পৌষ্টিক অর্থাৎ শ্রীলাভের জন্য, সাংমনস্য অর্থাৎ মৈত্রী লাভের জন্য, আভিচারিক অর্থাৎ শত্রুনাশের জন্য, প্রায়শ্চিত্ত, এবং রাজকর্ম অর্থাৎ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও উন্নতির জন্য। এই বিষয়গুলি গার্হস্থ্য ও সামাজিক বিষয় সংক্রান্ত। এ ধরনের মন্ত্রের ব্যবহার জন্য তিন বেদে সাধারণত পাওয়া যায় না। এই হল অথর্ববেদের প্রথম ভাগ।
অষ্টম হতে দ্বাদশ কান্ড অথর্ববেদের দ্বিতীয় ভাগ। এখানেও আভ্যুদয়িক কর্ম আছে। তবে অতিরিক্তভাবে দার্শনিক চিন্তা আছে। এই ধরনের সূক্তগুলি কোনও বৈদিক ক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করা যায় না। ঋগবেদের দশম মন্ডলের নানা দার্শনিক তত্ত্ব সম্পর্কিত সূক্তের সহিত এদের তুলনা চলে।
ত্রয়োদশ হতে বিংশ কান্ড অথর্ববেদের তৃতীয় ভাগ। শেষের দুটি কান্ড হল পরিশিষ্ট। অন্য কান্ডগুলির প্রত্যেকটির বিষয়য়বস্তু নির্দিষ্ট। ত্রয়োদশ কান্ডে রোহিত নামে আদিত্যের প্রসঙ্গ আছে। চতুর্দশ কান্ডের বিষয় বিবাহ প্রকরণ। পঞ্চদশ কান্ডে ব্রাত্যের প্রশংসা আছে। ষোড়শ কান্ডে নানা শান্তি স্বস্ত্যয়নের মন্ত্র আছে। সপ্তদশ কান্ডে আছে আদিত্যের স্তুতি এবং অষ্টাদশ কান্ডের বিষয় হল পিতৃমেধ।
সুতরাং অথর্ব সংহিতার শ্রৌত কর্ম হতে স্মার্ত কর্মেরই প্রাধান্য। অবশ্য শ্রৌত কর্মের আদৌ উল্লেখ যে নেই তা নয়। তবে প্রধানত স্মার্তকর্ম প্রাধান্য পাওয়ায় তার প্রকৃতি অন্য তিন বেদ হতে পৃথক।
এককালে বেদ যে তিনটি ছিল এবং চতুর্থ বেদ অথর্বের আবির্ভাব হয়নি তার প্রমাণ নানাভাবে পাওয়া যায়। নেই প্রমাণগুলি এবার একে একে স্থাপন করা হবে।
ঋগবেদের দশম মন্ডল সম্ভবত সবার শেষে রচিত হয়েছিল। তার একটি প্রমাণ তার সূক্তগুলি একেবারে এই বেদের প্রান্তে স্থাপিত। আরও ভাল প্রমাণ হল এই মন্ডলে এমন অনেকগুলি সূক্ত আছে যাদের সঙ্গে শ্রৌত কর্মের কোনও সংযোগ নেই। এগুলিকে মনুষ্য জাতির প্রথম দার্শনিক চিন্তা বলা যায়। চিন্তা পরিণতি লাভ করলেই ব্যবহারিক যাগযজ্ঞাদি ক্রিয়া হতে বিশুদ্ধ চিন্তায় সরে আসে।
এই দশম মন্ডলে পুরুষ সূক্তে (১০।৯০) সৃষ্টির একটি ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। সেই প্রসঙ্গে বেদগুলির উৎপত্তির কথাও আছে। তার নবম মন্ত্রে পাইঃ ‘সেই সর্বহোম সম্বলিত যজ্ঞ ঋক্ ও সাম সমূহ উৎপাদিত হল, ছন্দ সকল আবির্ভূত হল, যজুঃ তা হতে জন্মগ্রহণ করল।’ অর্থাৎ সৃষ্টির এই ব্যাখ্যায় তিন বেদের উল্লেখ আছে, চতুর্থ অথর্ববেদের উল্লেখ নেই। তার তাৎপর্য হল এই যে, এই সূক্ত যখন রচিত হয় তখন অথর্ববেদের আবির্ভাব হয়নি।
তারপর প্রমাণ পাই ব্রাহ্মণের যুগেও অথর্ববেদের সন্ধান পাওয়া যায় না। তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে বেদকে ‘ত্রয়ী বলা হয়েছে এবং এই ত্রয়ীর অন্তর্ভূক্ত বেদ হিসাবে কেবলমাত্র ঋক্, সাম ও যজুর্বেদের উল্লেখ করে হয়েছে। প্রাসঙ্গিক উক্তিটি এইঃ ‘যমৃষয়স্ত্রয়ীবিদ্যে বিদুঃ ঋচঃ সামানি যজুংষি ৷৷ (তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ১। ২।১।২৬)। সুতরাং এটা অনুমান করা অসঙ্গত হবে না এই ব্রাহ্মণ যখন রচিত হয় তখন অথর্ববেদের নাম জানা ছিল না।
তারপর আসে উপনিষদের যুগ। ছান্দোগ্য এবং বৃহদারণ্যক উপনিষদ প্রাচীনতম উপনিষদগুলির অন্যতম। এই দুটি উপনিষদই ব্রাহ্মণের অংশ। এদের আলোচনা হতে দেখা যায় যে এরা ‘ত্রয়ী’ কথাটির সঙ্গে পরিচিত এবং সেই সূত্রে যখন বেদের উল্লেখ করছে তখন অন্য তিনটি বেদের উল্লেখ আছে, কিন্তু অথর্ববেদের উল্লেখ নেই। আবার অন্য সূত্রে আলোচনায় চারটি বেদেরই উল্লেখ করা হয়েছে।
ছান্দোগ্য উপনিষদের প্রথম অধ্যায়ের চতুর্থ খন্ডে আছে মৃত্যু হতে ভয় পেয়ে দেবতারা ত্রয়ী বিদ্যায় প্রবেশ করল। (দেবা বৈ মৃত্যোর্বিভ্যতস্ত্রয়ীং বিদ্যাং প্রাবিশন্ ৷৷ ১ ৷৷ ৪ ৷৷ ২)। তারপর আছে তাঁরা ঋক্ সাম এবং যজুর স্বরের মধ্যে প্রবেশ করলেন। (তে তু বিত্ত্বোর্ধ্বা ঋচঃ সাম্নো যজুষঃ স্বরমের প্রাবিশন্ ৷৷১৷৷৪৷৷৩)। সুতরাং এখানে দেখি ঋক্ সাম ও যজুর্বেদকে ‘ত্রয়ী বিদ্যা’ বলে অভিহিত করা হয়েছে।
অপর পক্ষে একই উপনিষদের সপ্তম অধ্যায়ে দেখি নারদ যখন সনৎকুমারের কাছে ব্রহ্মবিদ্যা শিক্ষা লাভের জন্য গেছেন তখন তিনি জিজ্ঞাসা করছেন, নারদ কি বিদ্যা আয়ত্ত করেছেন। তখন নারদ যে বিষয়গুলি পাঠ করেছেন তাদের যে তালিকা দিলেন তার মধ্যে ঋক্ সাম যজু এবং অথর্ব এই চারটি বেদের উল্লেখ আছে (৭।১।২)। সুতরাং ছান্দোগ্য উপনিষদ যখন রচিত হয় তখন যে অথর্বব্দের আবির্ভাব হয়েছে তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
বৃহদারণ্যক উপনিষদেরও একই অবস্থা পাই। তার প্রথম অধ্যায়ের পঞ্চম ব্রাহ্মণে মাত্র প্রথম তিনটি বেদের উল্লেখ আছে। প্রাসঙ্গিক উক্তিটি এইঃ ত্রয়ো বেদা এত এব বাগের ঋগ্বেদো মনো যজুর্বেদঃ প্রাণঃ সামবেদঃ (১।৫।৫) অর্থাৎ তিনটি বেদের মধ্যে ঋগ্বেদ বাক্যের সঙ্গে তুলনীয়, সামবেদ প্রাণের সঙ্গে তুলনীয় এবং যজুর্বেদ মনের সঙ্গে তুলনীয়। এখানে কেবল তিনটি বেদেরই উল্লেখ পাই।
অথচ দেখি চতুর্থ অধ্যায়ে চারটি বেদেরই উল্লেখ আছে। সেখানে বলা হয়েছে ‘মহতো ভূতস্য নিঃশ্বসিতমেতদ্ যদৃগবেদো যজুর্বেদঃ সামবেদোহথর্বাঙ্গিরসঃ’ ৪।৫।১১)। তাৎপর্য হল ব্রহ্ম হতেই চারটি বেদের উৎপত্তি হয়েছে। এখানে স্পষ্টই প্রমাণ পাওয়া যায় বৃহদারণ্যক উপনিষদ যখন রচিত হয় তখন চারটি বেদের সহিত মানুষ পরিচিত ছিল।
সুতরাং এটা অনুমান করা যায় যে, এই দুই প্রাচীন উপনিষদ যখন রচিত হয় তখন তিন বেদের ধারণা একেবারে লুপ্ত হয়ে যায় নি। ‘ত্রয়ী’ বা ‘ত্রয়ো বেদাঃ’র ধারণা তখনও প্রচলিত ছিল। অবশ্য চতুর্থ বেদ অথর্বের তখন আবির্ভাব হয়েছে এবং তার সঙ্গেও মানুষের পরিচয় ছিল।
তারপর দেখি মুন্ডক উপনিষদে আর ‘ত্রয়ী’র উল্লেখ নেই; সোজাসুজি চারটি বেদকে বেদাঙ্গগুলিসহ অপরা বিদ্যার অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে (১।৫)। সুতরাং অনুমান করা যায় তখন ‘ত্রয়ী’র ধারণা লুপ্ত হয়েছে এবং চারটি বেদই সম্মানের আসন অধিষ্ঠিত হয়েছে। এই প্রসঙ্গে লক্ষ্য করা যেতে পারে যে, এই উপনিষদখানি কোনও বেদের সংহিতা বা ব্রাহ্মণ বা আরণ্যকের সঙ্গে সংযুক্ত আকারে পাওয়া যায় না। তা ঐতিহ্য অনুসারে অথর্ববেদের অন্তর্ভূক্ত। সুতরাং বুঝা যায় এটি ছান্দোগ্য এবং বৃহদারণ্যক উপনিষদ হতে অপ্রাচীন এবং এটি যখন রচিত হয় তখন অথর্ববেদ রচিত হয়ে গেছে।
সুতরাং দেখা যায় অথর্ববেদের যে অনেক পথে আবির্ভাব হয়েছিল তার একাধিক প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রথমত ঋক্, সাম ও যজুর্বেদ যেমন অঙ্গাঙ্গীভাবে পরস্পরের সহিত সংসুক্ত, অথর্ববেদের সহিত এদের তেমন সংযোগ নেই। দ্বিতীয়ত অথর্ববেদের প্রকৃতি এই তিনটি বেদ হতে বিভিন্ন। প্রথম তিনটি বেদে শ্রৌত কর্ম প্রাধান্য পেয়েছে। চতুর্থ বেদের আভ্যুদয়িক কর্ম প্রাধান্য পেয়েছে। তৃতীয়ত দেখি ব্রাহ্মণের যুগে বেদকে ‘ত্রয়ী’ বলা হত অর্থাৎ তখনও চারটি বেদের কথা মানুষ জানত না। ‘ত্রয়ী’ কথাটি উপনিষদের যুগেও প্রচলিত ছিল। তারপর অথর্ববেদ রচিত হয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করবার পর চারটি বেদের স্বীকৃতি উপনিষদ গুলিতে পাওয়া যায়। সুতরাং এমন অনুমান করা অসঙ্গত হবে না যে অথর্ববেদ তুলনায় অপ্রাচীন বেদ।
ঋগ্বেদ পরিচয় – (১) বৈদিক সাহিত্য
মুন্ডক উপনিষদে একটি বচন আছে। তা দিয়ে আমাদের আলোচনা আরম্ভ হতে পারে। বচনটি এইঃ
দ্বে বিদ্যে বেদিতব্যে এতি স্ম যদ্ব্রহ্মবিদো বদন্তি পরা চৈবাপরা ব ৷৷ ৪ তসপরা ঋগ্বেদঃ যজুর্বেদো সামবেদোহথর্ববেদঃ শিক্ষা কল্পো ব্যাকরণং নিরুক্তং ছন্দো জ্যোতিষ্মিতি। অথ পরা যয়া তদক্ষরষধিগম্যতে ৷৷ ৫ (প্রথম খন্ড)
তার অর্থ হলঃ ব্রহ্মবিদরা বলে থাকেন দুটি বিদ্যা আয়ত্ত করতে হবে, পরা এবং অপরা। অপরা হল ঋগবেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ, অথর্ববেদ, শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ ও জ্যোতিষ। আর পরা বিদ্যা হল তাই যার দ্বারা ব্রহ্মকে অধিকার করা যায়।
এই উক্তিতে বৈদিক সাহিত্যের একটি সম্পূর্ণ তালিকা পাওয়া যায়। দুভাগে বৈদিক সাহিত্যকে ভাগ করা হয়েছে। এক ভাগে আছে ব্রহ্মবিদ্যা অর্থাৎ বিশ্বের মধ্যে যে অবিনাশী সত্তা প্রচ্ছন্নভাবে ক্রিয়াশীল তার সন্বন্ধে জ্ঞান সঞ্চয় করা। এই জ্ঞান লিপিবদ্ধ হয়েছিল বেদেরই অঙ্গীভূত এবং আশ্রিত এক শ্রেণীর রচনায়।
তাদের আমরা উপনিষদ বলি। উপনিষদ অর্থে বুঝি বেদের প্রান্তে যা অবস্থিত। বেদান্ত অর্থেও তাই বুঝি। পরবর্তীকালের শঙ্করাচার্য প্রবর্তিত বেদান্ত দর্শন এই উপনিষদ বা বেদান্তের রচনাকেই অবলম্বন করে রচিত হয়েছিল।
দ্বিতীয় ভাগে পড়ে আর সব কিছু। তাদের মধ্যে প্রথম আছে চারটি বেদ – ঋক্, সাম, যজু এবং অথর্ব। তারপর যেগুলি আছে সেগুলি সংখ্যায় ছটি এবং তাদের সাধারণ নাম বেদাঙ্গ। তারা হল শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ ও জ্যোতিষ। তাদের কেন বেদাঙ্গ বলা হয় তা বুঝতে কিছু প্রাথমিক কথা বলার প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
ধর্মগ্রন্থ হিসাবেই বেদের উৎপত্তি। ধর্মের প্রধান উৎস হল বিশ্বের মূল শক্তিকে শ্রদ্ধা, ভক্তি বা অর্ঘ্য নিবেদনের আকূতি। এই আকূতির প্রেরণা নানা রকম হতে পারে। এই প্রসঙ্গে গীতায় ব্যবহৃত বিশ্লেষণটি প্রয়োগ করা যেতে পারে।
গীতায় বলা হয়েছে চার শ্রেণীর ভক্ত হতে পারেঃ আর্ত, অর্থাথী, ভক্ত ও জিজ্ঞাসু। যে আর্ত সে বিপদে পড়ে বিপদ হতে পরিত্রাণের জন্য পরম সত্তার সাহায্য প্রার্থনা করে।
যে অর্থাথী তার কোনও বিপদ ঘটেনি, কিন্তু কোনও বিশেষ ইচ্ছা পুরণের জন্য ঈশ্বরের প্রসাদ প্রার্থনা করে। যে ভক্ত, সে আরও উচ্চ স্তরের মানুষ। তার কোনও ব্যবহারিক প্রয়োজন নেই। ঈশ্বরের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা হেতু সে অহেতুক শ্রদ্ধা নিবেদন করে। আর যে জিজ্ঞাসু সে পরম সত্তাকে জানতে ইচ্ছা করে।
বেদ অতি প্রাচীনকালে রচিত হয়েছে। সে যুগে মানুষ ভক্তের স্তরে উঠতে শেখেনি। সে যুগে দেবতার উপাসনার প্রেরণা ছিল ব্যবহারিক প্রয়োজন। অর্থাৎ আর্ত বা অর্থাথীর মনোভাব নিয়ে দেবতার পূজা হত।
বেদের যুগে উপাসনা রীতির একটি বৈশিষ্ট্য ছিল। ঠিক বলতে কি তা অনন্য-সাধারণ। এ ধরনের রীতি অন্য কোনও দেশে দেখা যায়নি। অবশ্য পারসিক সম্প্রদায় অগ্নির উপাসনা করে। তবে বৈদিক যজ্ঞরীতি ভিন্ন ধরনের। প্রকৃতির বক্ষে যেখানে সেকালে ঋষি শক্তির বা সৌন্দর্যের উৎস আবিষ্কার করেছে, তার ওপরেই দেবত্ব আরোপ করে তার জন্য স্তোত্র রচনা করেছেন।
এই স্তোত্রের নাম হল সূক্ত। এইভাবে অগ্নি দেবতার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে। তিনি শুধু দেবতা নন পুরোহিতও বটেন; কারণ অগ্নিতেই অন্য দেবতার উদ্দেশে আহুতি দেওয়া হত। বায়ু দেবতার পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন, জলের দেবতা বরুণ অধিষ্ঠিত হয়েছেন। আকাশের সূর্য মহাশক্তির উৎস তিনিও দেবত্বে অধিষ্ঠিত হয়েছেন।
ভোরবেলায় আকাশের রাঙিমা ঋষির মনকে মুগ্ধ করেছে। তিনিও ঊষা নামে অভিহিত হয়ে দেবত্বে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। পৃথিবী ও আকাশ দ্যৌ নামে দেবতা পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। এঁদের এবং অন্যান্য দেবতাদের উদ্দেশ্যে যে স্ত্রোত্র রচিত তাই নিয়েই বেদের জন্ম।
সূক্ত নিয়ে গঠিত বেদের এই মূল অংশকে বলা হয় সংহিতা। পরবর্তীকালে তার সঙ্গে অন্য অংশ যুক্ত হয়েছে। বেদের সূক্তগুলি রচিত হয়েছে প্রাচীন ভাষায়।
বেদে তা ব্যবহৃত হয়েছে বলে আমরা তাকে বৈদিক ভাষা বলি। এখন শ্রদ্ধা নিবেদন বা প্রার্থনা জ্ঞাপন শুধু স্তোত্র পাঠেই হয় না। তার সঙ্গে কিছু আনুষঙ্গিক ক্রিয়া থাকে। বৈদিক যুগে সেই আনুষ্ঠানিক অংশ প্রধানতঃ রূপ নিত যজ্ঞানুষ্ঠানের।
এই যজ্ঞের উপকরণ খুব সরল ছিল। একটি বেদী নির্মিত হত। তার উপর কাঠ দিয়ে আগুন জালানো হত। সেই সঙ্গে বৈদিক মন্ত পাঠ হত বা সুর সংযোগে গাওয়া হত। তার সঙ্গে ঘৃতের আহূতি দেওয়া হত। সোম নামে এক লতা সেকালে জন্মাত। তার রসও আহূতি হিসাবে দেবতাদের উদ্দেশ্য নিক্ষিপ্ত হত।
এখন বিভিন্ন ধরনের যজ্ঞ আছে। কোনোটিকে বলা হয় অগ্নিষ্টোম, কোনোটিকে জ্যোতিটোম, কোনটিকে বিশ্বজিৎ। আবার কতদিন ধরে একটি যজ্ঞ স্থায়ী হত তার ভিত্তিতে বিভিন্ন নামকরণ হত।
যেমন যে যজ্ঞ বারো দিনের বেশী স্থায়ী হত তাকে বলা হত সত্র। এইসব বিষয় বিধি-নিষেধ নির্দেশ করবার জন্য ব্রাহ্মণের উৎপত্তি হয়। এই ব্রাহ্মণগুলিতে বিভিন্ন যজ্ঞ কি করে নিষ্পাদিত করতে হয় তার সবিস্তার বিবরণ আছে। যেমন ঋগ্বেদের অন্তর্ভূক্ত ঐতরেয় ব্রাহ্মণে রাজসূয় যজ্ঞের বিবরণ আছে। ব্রাহ্মণগুলি সংস্কৃত ভাষায় রচিত।
আপস্তম্ব শ্রৌত সূত্রে বলা হয়েছে ”মন্ত্রব্রাহ্মণয়োর্বেদনামধেয়ম্” (২৪।১।৩১৬) অর্থাৎ সংহিতা অংশে সেখানে সূক্তগুলি আছে এবং ব্রাহ্মণ যেখানে যজ্ঞের বিধি নির্দেশ করা হয়েছে এ নিয়ে বেদ। অনেকগুলি মন্ত্র নিয়ে এক একটি সূক্ত রচিত হয়েছে।
কিন্তু আমরা জানি আরণ্যক ও উপনিষদও বেদের অঙ্গ। তাদেরও ব্রাহ্মণের অংশ ধরে নিতে হবে। তা না হলে তারা বাদ পড়ে যায়। ঠিক বলতে কি বৈদিক ঐতিহ্য অনুসারে আরণ্যকগুলি ব্রাহ্মণের অংশ এবং উপনিষদ গুলি আরণ্যকের অংশ। তাই জৈমিণি বলেছেন মন্ত্রাতিরিক্ত বেদভাগের নামই ব্রাহ্মণ। (মীমাংসা সূত্র, ২।১।৩৩)।
আরণ্যক ও উপনিষদ ব্রাহ্মণের অঙ্গ হলেও তাদের প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য আছে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে মন্ত্র, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ এই সমগ্র সাহিত্যকে দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। একটি কর্মকান্ড ও অপরটি জ্ঞানকান্ড। কর্মকান্ডে যজ্ঞ সম্পর্কিত বিষয়গুলি আছে। সুতরাং তার অন্তর্ভূক্ত হবে বেদের সংহিতা বা মন্ত্র অংশ এবং ব্রাহ্মণ অংশ; কারণ তাতে যজ্ঞের বিধি-নিষেধের আলোচনা আছে।
উপনিষদে ব্রহ্মতত্ত্বের বিষয় আলোচনা আছে সুতরাং তা জ্ঞান-কান্ডের মধ্যে গিয়ে পড়ে। আরণ্যকের স্থান এদের মধ্যবর্তী। এতে কর্ম অর্থাৎ যজ্ঞ এবং জ্ঞান উভয় সন্বন্ধেই আলোচনা পাওয়া যায়। প্রতি বেদের সঙ্গে সংযুক্ত ব্রাহ্মণ পাওয়া যায়; কিন্তু প্রতি বেদের সঙ্গে সংযুক্ত আরণ্যক পাওয়া যায় না। যেমন অথর্ববেদের একটি ব্রাহ্মণ আছে; কিন্তু তার অন্তর্ভূক্ত কোনও আরণ্যক পাওয়া যায় না।
সুতরাং জ্ঞানকান্ড হিসাবে উপনিষদেরই ভুমিকা প্রধান। সেই কারণে আমাদের উপনিষদের বিষয়ে একটু বিস্তারিত আলোচনা করতে হবে। তার আগে যজ্ঞানুষ্ঠানের বিষয় কিছু প্রাথমিক কথা বলা প্রয়োজন।
যজ্ঞানুষ্ঠানে বিভিন্ন ব্যক্তির বিভিন্ন ভূমিকা থাকত। যজ্ঞের সংজ্ঞা হিসাবে বলা হয়েছে ‘দেবতার উদ্দেশ্যে দ্রব্য ত্যাগ যজ্ঞ।’ অর্থাৎ যজ্ঞ করতে যে সমস্ত সামগ্রীর প্রয়োজন হতো, যেমন সমিধ বা কাঠ, আহুতির জন্য ঘৃত, সোমরস প্রভৃতি সরবরাহ করতে হত। যিনি দ্রব্য ত্যাগ করেন তিনি হলেন যজমান। অর্থাৎ তাঁরই কল্যাণ কামনায় যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হতো সুতরাং তাঁকেই এই দ্রব্যগুলি সরবরাহ করতে হত।
আর যাঁরা যজ্ঞের অনুষ্ঠান করতেন তাঁদের বলা হতো ঋত্বিক। এই ঋত্বিকদের মধ্যে আবার ভূমিকা বিভিন্ন ছিল। তার ভিত্তিতে তাঁদের মধ্যে শ্রেণী বিভাগ আছে। যেমন যিনি সূক্ত পাঠ করতেন তাঁর নাম হল হোতা। যিনি এই সূক্ত গান করে পাঠ করতেন তাঁর নাম হল উদ্গাতা। আর যিনি অগ্নিতে আহুতি দিতেন তাঁর নাম হল অধ্বর্যু। সুতরাং বৈদিক যজ্ঞানুষ্ঠানে অনেকের ভুমিকা ছিল। আগুন জ্বেলে একটি ভাবগম্ভীর সমাবেশে তা অনেকের সাহচর্যে অনুষ্ঠিত হতো।
বৈদিক যজ্ঞের সন্বন্ধে একটি অপবাদ প্রচারিত আছে যে তাতে অনেক পশুবলি হত। এমন কি কবি জয়দেব রচিত ‘গীতাগোবিন্দ’ কাব্যে দশাবতারের বর্ণনায় পশু হত্যার উল্লেখ আছে।
পশু যে বলি হতো না তা নয়। তবে তার সংখ্যা খুব সীমাবদ্ধ ছিল। কতকগুলি নির্বাচিত যজ্ঞে কেবল পশুহত্যার ব্যবস্থা ছিল। আহিতাগ্নি যজ্ঞে পশুবধ অবশ্য-কর্তব্য ছিল; কিন্তু তাতে মাত্র একটি পশু বলি হত। সোমযাগে একাধিক পশু ব্যবহৃত হত।
কিন্তু তাদের সংখ্যা নির্দিষ্ট ছিল। তাছাড়া এ যাগ অত্যন্ত ব্যয়সাধ্য হওয়ায় খুব কম সংখ্যায় অনুষ্ঠিত হত। (অনির্বাণ-বেদ মীমাংসা, ২য় খন্ড পৃঃ ৪৪১)। অশ্বমেধ যজ্ঞের বিবরণ আমরা পাই। তাতে কেবল একটি অশ্ব হত্যা করা হত।
এখন আমরা উপনিষদের আলোচনায় ফিরে যাব। উপনিষদের অর্থ নিয়ে কিছু বিতর্ক আছে। প্রথমেই যে বিষয় আলোচনা করে নিতে পারি।
ডয়সন উপনিষদকে রহস্যগত জ্ঞান বলে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে এই জ্ঞান রহস্যপূর্ণ হওয়ায় গুরুর নিকট একান্তে বসে আলোচনা হতেই এই বিদ্যা সম্ভব। গুরুর সন্নিধিতে বসে আয়ত্ত হত বলে তার নাম উপনিষদ (Deussen, Philosophy of Upanishads p. 14-15).
ম্যাক্সমূলার বলেছেন প্রথমে উপনিষদ বোঝাত একটি সভা। সেখানে গুরু হতে একটি ব্যবধান রক্ষা করে শিষ্যরা তাঁকে ঘিরে সমবেত হত। শিষ্য গুরুর নিকটে বসে এই বিষয় চর্চা করত বলেই এর নাম উপনিষদ। (Maxmuller, Sacred Books of the East, Introduction)
অষ্টোত্তর শত উপনিষদের সংকলক পন্ডিত বাসুদেব শর্মা বলেনঃ উপ অর্থে গুরুর উপদেশ হতে লব্ধ; নি অর্থে নিশ্চিত জ্ঞান; সৎ অর্থে যা জন্মমৃত্যুর বন্ধনকে খন্ডন করে। সুতরাং অর্থ দাঁড়ায় গুরুর নিকট হতে লব্ধ যে নিশ্চিত জ্ঞান জন্মমৃত্যুর বন্ধন খন্ডন করে তাই হল উপনিষদ।
মনে হয় উপনিষদের একটি সহজ ব্যুৎপত্তিগত অর্থ পাওয়া যায়। অপরদিকে উপরের ব্যাখ্যাগুলির বিপক্ষে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। উপনিষদের অলোচনা গুরুশিষ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত না। বৃহদারণ্যক উপনিষদের দ্বিতীয় ও তৃতীয় অধ্যায়ে আমরা দেখি ব্রহ্মতত্ত্বের আলোচনা অনুষ্ঠিত হত। কাজেই দয়সন ও ম্যাস্কমূলারের উক্তি সম্পূর্ণভাবে সমর্থিত হয় না।
বাসুদেব শর্মা মুক্তির উপায় হিসাবে উপনিষদের ব্যবহার করেছেন এবং সেই অর্থ তার মধ্যে আবিষ্কার করেছেন। কিন্তু উপনিষদের যুগে মুক্তির স্পৃহা মানুষের মধ্যে বলবতী হয়নি। সেটা ঘটেছিল পরবর্তীকালে ষড় দর্শনের যুগে। কর্মফল ও পরজন্মবাদ বদ্ধমূল সংষ্কারে রূপান্তরিত হবার পরেই মুক্তির চিন্তা ভারতীয়দের মনে উদয় হয়। উপনিষদের যুগে জন্মান্তরবাদ ঠিক গড়ে ওঠেনি। এ বিষয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা চলেছে মাত্র। কাজেই তখন মুক্তি-স্পৃহা জানবার নময় আসেনি। বিশ্ব হতে পলায়ন করবার মনোভাব তখনো মানুষের মনে জাগেনি। জীবনকে আনন্দময় মনে করা হত। বিশ্বকে বলা হত ‘আনন্দরূপম-মৃতং যদ্বিভাতি’ (মুন্ডক ২।২।৭)। সুতরাং এই মানসিক পরিবেশে মুক্তিচিন্তা মানুষের মনে আসে না। কাজেই মনে হয় বাসুদেব শর্মার ব্যাখ্যা কল্পিত এবং গ্রহণযোগ্য নয়।
সুতরাং উপনিষদের সহজ সরল ব্যুৎপত্তিগত অর্থ গ্রহণ করাই যুক্তিসঙ্গত মনে হয়। উপনিষদ অর্থে বুঝি যা এক প্রান্তে অবস্থিত। বেদের এক প্রান্তে বসে আছে বলেই তা উপনিষদ। তাকে বেদান্তের সমার্থবোধক শব্দ হিসাবে ব্যবহার করতে পারি। বেদান্তেরও অর্থ বেদের শেষে যা আছে তাই। শব্দটি শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে ব্যবহৃত হয়েছে।
আমরা এখানে বলেছিলাম যে উপনিষদগুলি বেদের আশ্রিত হয়ে গড়ে উঠেছে। কিন্তু পরবর্তীকালে পরিস্থিতির অনুকূল্যে অন্য সূত্রেও অনেক উপনিষদ রচিত হয়েছে। তারা বেদের অঙ্গীভূত নয়।
এমন ঘটনার একটা কারণ ছিল। প্রাচীনকালে উপনিষদের মর্যাদা এমন বৃদ্ধি পেয়েছিল যে পরবর্তীকালে বিভিন্ন দার্শনিক তত্ত্ব উপনিষদ নামে প্রচারিত হয়েছিল। সম্ভবত নামের আভিজাত্যের গুণে তাদের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করবার ইচ্ছা এই রীতির পেছনে সক্রিয় ছিল। মুক্তিক উপনিষদে ১০৮ খানি উপনিষদের উল্লেখ আছে। নির্ণয় সাগর প্রেস হতে বাসুদেব লক্ষণ শাস্ত্রী উপনিষদের যে সংকলন গ্রন্থ বার করেছিলেন তাতে ১১২টি উপনিষদ স্থান পেয়েছে। তার যে সাম্প্রতিক সংস্করণ বেরিয়েছে তাতে ১২০ খানি উপনিষদ প্রকাশিত। এদের বেশীর ভাগই বেদের যুগে রচিত নয়, পরবর্তীকালে রচিত হয়েছিল। এখন আমাদের প্রকৃত বৈদিক যুগের উপনিষদ হতে পরবর্তীকালে রচিত উপনিষদগুলি পৃথক করে নেওয়া প্রয়োজন।
সৌভাগ্যক্রমে এ বিষয়ে আমাদের সাহায্য করতে পারে এমন দুটি অনুকূল অবস্থা পাওয়া যায়। প্রথমত দেখি ভারতীয় দাশর্নিক চিন্তার রূপ বিভিন্নকালে পরিবর্তিত হয়েছে।
বেদের কর্মকান্ডে যে চিন্তা পাই উপনিষদে তা পাই না। বড় দর্শনের যুগে আবার চিন্তার রূপ পরিবর্তিত হয়েছে। পরে পৌরাণিক যুগে আবার চিন্তার পরিবর্তন ঘটেছে।
দ্বিতীয়ত, প্রাচীন উপনিষদগুলি বৈদিক সাহিত্যের কথা হিসাবে গড়ে উঠেছিল এবং একটি বিশেষ তত্ত্ব তাদের অবলম্বন করে গড়ে উঠেছিল। তাকে ব্রহ্মবাদ বলতে পারি। সুতরাং এই দুই লক্ষণ দ্বারা বৈদিক যুগের উপনিষদ গুলিকে পৃথক করে নিতে পারি। প্রথমত যে উপনিষদের চিন্তা প্রাচীন উপনিষদের চিন্তাধারার সঙ্গে সঙ্গতি রাখে না তাকে পৃথক করে রাখতে পারি। দ্বিতীয়ত যে উপনিষদের বেদের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী সন্বন্ধ আবিস্কৃত হবে তাকে বৈদিক যুগের উপনিষদ বলে স্বীকার করে নিতে পারি।
ভারতীয় দার্শনিক আলোচনায় চারটি দার্শনিক চিন্তা কালানুক্রমে আবিস্কার করা যায়। প্রথমত বেদের কর্মকান্ডে সংহিতা অংশে প্রাচীনতম অবস্থাটি পায়। তখন নানা প্রাকৃতিক শক্তির উপর দেবত্ব আরোপ করে যজ্ঞে তাঁদের আহবান করে উপয়াসনা করা হত।
এই উপাসনা রীতি বিশুদ্ধ ব্যবহারিক প্রয়োজন দ্বারা অনুপ্রাণিত। শত্রু হতে রক্ষা বা বিপদ হতে ত্রাণ এনং অভীষ্ট পূরণের জন্য এই উপাসনায় প্রার্থনা নিবেদিত হত। সঙ্গে সঙ্গে দেবতাদের উদ্দেশ্যে প্রশস্তিও নিবেদিত হত।
বেদের মধ্যেই শেষের দিকে জ্ঞানকান্ডের প্রতি ঝোঁক দেখা যায়। ঋগ্বেদের মধ্যেই বিশেষ করে দশম মন্ডলে এমন অনেক সূক্ত আছে যেখানে নানা দার্শনিক প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। এখানে যে চিন্তার সুত্রপাত হয়েছে তার বিকাশ ঘটেছে বিভিন্ন বেদের সহিত সংযুক্ত উপনিষদগুলির মধ্যে। এখানে ঋষির জিজ্ঞাসু দৃষ্টি প্রবল হয়ে উঠেছে। ব্যবহারিক প্রয়োজনের ঊর্ধ্বে উঠে তিনি বিশ্বসত্তার পরিচয় পেতে ব্যগ্র হয়ে উঠেছেন।
এই জিজ্ঞাসার ফলে যে দর্শন গড়ে উঠেছে তাকে আমরা সর্বেশ্বরবাদ বলতে পারি। এই দর্শন বলে সকল মানুষ, সকল জীব, সকল বস্তুকে জড়িয়ে নিয়ে এক মহাশক্তি সবকিছে ব্যাপ্ত করে আছেন এবং প্রচ্ছন্ন থেকে তাদের নিয়ন্ত্রণ করছেন। এইভাবে প্রাচীন উপনিষদে যে তত্ত্বটি গড়ে উঠেছে তাতে বিশুদ্ধ জিজ্ঞাসুর দৃষ্টিভঙ্গী পাই।
আমাদের দেশের দার্শনিক চিন্তার পরবর্তী যুগটি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিভঙ্গীরই একটি পরিবর্তিত রূপ। এখানেও জিজ্ঞাসু দৃষ্টিভঙ্গী ক্রিয়াশীল, তবে প্রেরণা এসেছে ভিন্ন পথে। এখানে প্রেরণা এসেছে ব্যবহারিক প্রয়োজনে। এ যুগে কর্মফল তত্ত্ব এবং তার সঙ্গে সংযুক্ত পরজন্মবাদ বদ্ধমূল সংস্কারে পরিণত হয়েছে। সঙ্গে এই ধারণা গড়ে উঠেছে যে পার্থিব জীবন সুখের নয়, দুখের। ফলে পরজন্ম হতে মুক্তির আকাঙ্খা তীব্র হয়ে উঠেছে। সেই মুক্তির উপায় হিসাবে জ্ঞান-মার্গকেই অবলম্বন করা হয়েছে।
একথা যেমন হিন্দু ষড় দর্শন সন্বন্ধে খাটে তেমন বৌদ্ধ ও জৈন দর্শন সন্বন্ধেও খাটে। বৌদ্ধ ও জৈন দর্শনও পরজন্ম হতে পরিত্রাণ চায় এবং তার ব্যাখ্যার জন্য স্বতন্ত্র দর্শন গড়ে তুলেছে। অবশ্য উভয়ক্ষেত্রেই দর্শন ব্যতীত একটি কর্মরীতি প্রচার করা হয়েছে। ভগবান বুদ্ধ আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ প্রবর্তন করেছিলেন। অনুরূপভাবে জৈন ধর্মে সম্যক চরিত্রকেও মোক্ষলাভের অন্যতম উপায় হিসাবে স্বীকার করা হয়েছে। সুতরাং এই অবস্থায়ও জিজ্ঞাসু দৃষ্টিভঙ্গি প্রবল।
চতুর্থ অবস্থায় পৌরাণিক যুগে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত হয়ে ভক্তের দৃষ্টিভঙ্গি আসে। সাধারণভাবে বলা যায় ষড় দর্শনের যুগে ভক্তের দৃষ্টিভঙ্গি পরিস্ফুট ছিল না।
তবে তার প্রস্তুতি পর্ব শুরু হয়ে গিয়েছিল। বৌদ্ধ ও জৈন দর্শন ঈশ্বর সন্বন্ধে একেবারে নীরব। ষড় দর্শনের মধ্যে অধিকাংশ দর্শনই ব্যক্তিরূপী ঈশ্বর সন্বন্ধে নীরব। পুর্ব মীমাংসা ও উত্তর মীমাংসা এ প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত নয়।
সাংখ্য দর্শনেও ঈশ্বরের স্বীকৃতি নেই। বৈশেষিক দর্শনেও নেই। যোগ দর্শনে ঈশ্বর নানা তত্ত্বের মধ্যে একটি অতিরিক্ত তত্ত্ব হিসেবে স্বীকৃত। একেশ্বরবাদের ঈশ্বর যে মহিমায় অধিষ্ঠিত তার ধারে কাছেও তিনি যান নে।
ন্যায় সূত্রে ঈশ্বরের উল্লেখ আছে কিন্তু এখানে তাঁর অস্তিত্বের প্রমাণই মুখ্য বিষয়। ভক্তির দৃষ্টিভঙ্গি এখানেও অনুপস্থিত। পূর্ব মীমাংসায় বেদের প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। সুতরাং বৈদিক দেবতারা স্বীকৃত; কিন্তু একশ্বরবাদের দেবতার বিষয় তা উদাসীন।
তারপর এসেছে পৌরাণিক যুগ। তখন দেখি ঈশ্বরকে বিশ্বের কেন্দ্রস্থলে স্থাপন করে তাঁর ওপর সকল মৌলিক শক্তি আরোপ করে তাঁকে ব্যক্তিরূপী সত্তা হিসাবে কল্পনা করা হয়েছে। তখনই ভারতের চিন্তাধারায় একেশ্বরবাদ পূর্ণ মহিমায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
শিব বা শক্তি বা বিষ্ণু বা তাঁর অবতাররূপে গ্রহণ করে ঈশ্বরকে সর্বশক্তিমান ও ব্যক্তিরূপী বলে গ্রহণ করা হয়েছে। তিনিই একমাত্র অবলম্বন এবং একমাত্র গতি। ঈশ্বরে ভক্তিই এখানে মূল সুর রূপে পরিস্ফুট হয়েছে।
সুতরাং ভারতীয় দর্শনের চিন্তায় চারটি স্তর পাই। প্রথমে বেদের কর্মকান্ডের যুগ। সেখানে প্রকৃতির বহু শক্তিকে দেবতারূপে স্বীকৃতি দান করা হয়েছে। ধর্ম সেখানে ব্যবহারিক প্রয়োজনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হলেও জিজ্ঞাসু দৃষ্টিভঙ্গিরও সহাবস্থিতি ঘটেছিল। দ্বিতীয় অবস্থা পাই উপনিষদের যুগে। সেখানে মানুষের মন ব্যবহারিক প্রয়োজন বোধকে উপেক্ষা করে জ্ঞানমার্গে বিশ্বসত্তাকে জানবার জন্য আগ্রহশীল হয়েছিল। ফলে ব্রহ্মবাদ গড়ে উথেছিল – তৃতীয় স্তর পড়ে ষড় দর্শনের যুগে।
তখন ব্যবহারিক প্রয়োজনবোধের আবার আবির্ভাব হয়েছে, কিন্তু ভিন্ন ভাবে। দুঃখ হতে পরিত্রাণ বা ইচ্ছা পুরণের জন্য নয়, জন্মবন্ধন হতে মুক্তিলাভের জন্য। তবে তার উপায় হিসাবে জ্ঞানমার্গকেই অবলম্বন করা হয়েছে। শেষের অবস্থা পাই পূরাণের যুগে। তখন বিশ্বসত্তা ব্যক্তিরূপী ঈশ্বর হিসাবে কল্পিত হয়েছেন এবং তাঁর প্রতি অহেতুক ভক্তি হয়ে উঠেছে সাধনার রীতি।
মুক্তির উপনিষদে যে ১০৮ খানি উপনিষদের উল্লেখ আছে তা নির্ণয় সাগর প্রেসের সংকলনে যে অতিরিক্ত উপনিষদগুলির উল্লেখ আছে, সেগুলির বিষয়বস্তু বিচার করলে দেখা যাবে তারা এই চারশ্রেণীর মধ্যে পড়ে যাবে। সেই শ্রেণীগুলি দাঁড়াবে এইঃ
(১) ব্রহ্মবাদী উপনিষদ;
(২) সন্ন্যাসবাদী উপনিষদ। এগুলির উপর যোগদর্শনের প্রভাব সুস্পষ্ট।
(৩) যোগবাদী উপনিষদ। এগুলি যোগ অভ্যাসে উৎসাহ দেয়;
(৪) ভক্তবাদী উপনিষদ যা বিভিন্ন পৌরাণিক দেবতার আরাধনায় উৎসাহ দিয়েছে।
এদের মধ্যে বেদের অঙ্গীভুত বা বৈদিক যুগের উপনিষদগুলি প্রথম শ্রেণীতে পড়বে। অন্যগুলিকে বৈদিক সাহিত্যের অংশ বলে স্বীকার করা যায় না। তারা অনেক পরে রচিত হয়েছে।
এখন আমরা দেখব যে উপনিষদগুলি প্রথম শ্রেণীতে স্থাপন করা যায় তাদের দুটি বৈশিষ্ট্য আছে। প্রথমত তারা সকলেই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিভঙ্গী দ্বারা প্রভাবান্বিতএবং এক সর্বব্যাপী প্রচ্ছন্ন সত্তার পরিছয় দেয়। অর্থাৎ তারা ব্রহ্মবাদী। দ্বিতীয়ত তারা হয় বেদের সঙ্গে সোজাসুজি যুক্ত না হয় ঐতিহ্য অনুসারে যুক্ত।
যেখানে তারা বেদের সঙ্গে সোজাসুজি যুক্ত সেখানে তারা বেদের সংহিতা অংশ বা ব্রাহ্মণ অংশ বা আরন্যক অংশের অঙ্গীভূত। এইভাবে আমরা ১২ খানি উপনিষদ আবিস্কার করি যাদের পূর্বের তালিকার প্রথম শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত এবং বৈদিক সাহিত্যের অঙ্গ হিসাবে পরিগণিত করতে পারে। নীচে তাদের একটা তালিকা দেওয়া হল।
(ক) বেদের অঙ্গীভূত উপনিষদঃ
(১) ঈশ, শুক্ল যজুর্বেদের বাজসনেয় সংহিতার অংশ
(২) ঐতরেয়, ঋগ্বেদের ঐতরেয় আরণ্যকের অংশ
(৩) কৌষীতকি, ঋগ্বেদের শাংখ্যায়ন আরণ্যকের অংশ
(৪) তৈত্তিরীয়, কৃষ্ণ যজুর্বেদের তৈত্তিরীয় আরণ্যকের অংশ
(৫) বৃহদারণ্যক, শুক্ল যজুর্বেদের শতপথ ব্রাহ্মণের অংশ
(৬) কেন, সামবেদের জৈমিনীয় বা তলবকার ব্রাহ্মণের অংশ
(৭) ছান্দোগ্য, সামবেদের ছান্দোগ্য ব্রাহ্মনের অংশ
(৮) প্রশ্ন, অথর্ববেদের পৈপ্পলাদ শাখার অন্তর্ভূক্ত
(খ) ঐতিহ্য অনুসারে বেদের সহিত সংযুক্তঃ
(৯) কঠ, ঐতিহ্য অনুসারে কৃষ্ণ যজুর্বেদের অন্তর্ভূক্ত
(১০) শ্বেতাশ্বতর, ঐতিহ্য অনুসারে কৃষ্ণ যজুর্বেদের অন্তর্ভূক্ত
(১১) মুন্ডক, ঐতিহ্য অনুসারে অথর্ব বেদের অন্তর্ভূক্ত
(১২) মান্ডুক্য, ঐতিহ্য অনুসারে অথর্ব বেদের অন্তর্ভূক্তnull
আমরা চারটি বেদের কথা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি। তারা হল, ঋক্, সাম, যজুঃ এবং অথর্ব। আমরা আরও বলেছি মন্ত্র ও ব্রাহ্মণ নিয়ে উপনিষদ এবং ব্রাহ্মণের অন্তর্ভূক্ত হল আরণ্যক ও উপনিষদ। এই বিভাগ মোটামুটি প্রতিটি বেদ সন্বন্ধে প্রযোজ্য। এখন কোন বেদের সহিত কোন ব্রাহ্মণ, কোন আরণ্যক এবং কোন উপনিষদ সংযুক্ত তা দেখানো যেতে পারে।
ঋগ্বেদের সঙ্গে সংযুক্ত দুটি ব্রাহ্মণ আছে। তারা হল ঐতরেয় ব্রাহ্মণ এবং কৌষীতকি বা শাঙ্খায়ন ব্রাহ্মণ। উভয় ব্রাহ্মণের সঙ্গে একই নামে চিহ্নিত আরণ্যক আছে। সুতরাং তাদের নাম ঐতরেয় আরণ্যক ও কৌষীতকি আরণ্যক। ঐতরেয় আরণ্যকের সঙ্গে সংযুক্ত ঐতরেয় উপনিষদ এবং কৌষীতকি আরণ্যকের সঙ্গে যুক্ত কৌষীতকি উপনিষদ।
সামবেদের অন্তর্ভূক্ত তিনটি ব্র৫য়াহ্মণ আছে। তারা হল তান্ড্য মহাব্রাহ্মণ, ষড়বিংশ ব্রাহ্মণ এনং ছান্দোগ্য বা জৈমিনীয় বা উপনিষদ ব্রাহ্মণ। এই আরণ্যক দুটির আশ্রিত দুটি উপনিষদঃ ছান্দোগ্য ও কেন।
বর্তমানে সামবেদের তিনটি শাখা পাওয়া যায়; কৌযুন, রাণায়ণীয় এবং জৈমিনীয় বা তলবকার। তাদের মধ্যে কৌযুন শাখাই বেশী প্রচলিত। সাম বেদের তিনটি প্রধান ব্রাহ্মণঃ জৈমিনীয় বা তলবকার ব্রাহ্মণ, তান্ড্য বা পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণ এবং মন্ত্র বা ছান্দোগ্য ব্রাহ্মণ। কেন উপনিষদ তলবকার ব্রাহ্মণের অন্তর্ভূক্ত। ছান্দোগ্য উপনিষদ ছান্দোগ্য ব্রাহ্মণের অংশ।
বর্তমান যজুর্বেদে দুটি শাখা পাওয়া যায়। শুক্ল যজুর্বেদ ও কৃষ্ণ যজুর্বেদ। শুক্ল যজুর্বেদ সুষ্ঠু যজ্ঞ প্রযুক্ত মন্ত্রের সংকলন। সেই কারণেই সম্ভবত তাকে শুক্ল বা বিশুদ্ধ বলা হয়। কৃষ্ণ যজুর্বেদে মন্ত্র ছাড়া অতিরিক্তভাবে যজ্ঞানুষ্ঠানের ব্যাখ্যাও আছে। সেইজন্যই সম্ভবত তার কৃষ্ণ যজুর্বেদ নাম। যজুর্বেদের মন্ত্রগুলি অধিকাংশ গদ্যে রচিত। এই মন্ত্রগুলি যিনি পাঠ করতেন তাঁকে অধ্বর্যূ বলা হত। শুক্ল যজুর্বেদের আর এক নাম বাজসনেয়ী সংহিতা। তার প্রাচীন আচার্য যাজ্ঞবল্ক্য বাজসনেয় হতে এ নাম হয়েছে।
কৃষ্ণ যজুর্বেদে একটি ব্রাহ্মণ আছে। তার নাম ঐত্তিরীয়। তার আরণ্যকের নামও তৈত্তিরীয়। সেই আরণ্যকের আশ্রিত উপনিষদের নামও তৈত্তিরীয়।
শুক্ল যজুর্বেদের শতপথ ব্রাহ্মণ নামে একটি ব্রাহ্মণ আছে। তার আশ্রিত আরণ্যক এই ব্রাহ্মণেরি অংশ এবং একই নামে প্রচলিত। এই বেদের আশ্রিত দুটি উপনিষদঃ বৃহদারণ্যক ও ঈশ। বৃহদারণ্যক সব থেকে বড় উপনিষদ। ঈশ উপনিষদ এই বেদের সংহিতার অংশ।
অথর্ব বেদের প্রাচীন নাম ছিল অথর্বাঙ্গিরস। অথর্বন ও অঙ্গিরাগণ সুপ্রাচীনকালের ঋষি ছিলেন। সুতরাং তার উৎপত্তি প্রাচীনকালে হয়েছিল।
তাকে তার প্রকৃতি দেখে মনে হয় তার অনেক অংশ অপ্রাচীনকালে রচিত হয়েছিল। অথর্ববেদের প্রধান্তম বিষয়বস্তু হল যাদুবিদ্যা। এক ধরনের যাদুবিদ্যার নাম ভৈষজ্যানি। তার উদ্দেশ্য নানা রোগের উপশম সাধন। এই উপশমের জন্য যেমন ভূত ঝাড়ানোর ব্যবস্থা আছে তেমন রোগ নিরাময়ের উপযোগী নানা রকম লতাগুল্মের ব্যবহারের নির্দেশ আছে।
অথর্বেদে একটি মাত্র ব্রাহ্মণ আছে। তার নাম গোপথ ব্রাহ্মণ। তার সঙ্গে সংযুক্ত কোনও আরণ্যক নেই। তবে প্রশ্ন উপনিষদ এই বেদের পৈপ্পলাদ শাখার অন্তভুর্ক্ত।
তারপর আসে বেদাঙ্গ। এই বিষয়গুলি বেদ পাঠ এবং যজ্ঞ অনুষ্ঠানে সাহায্যে করত বলে এদের নাম বেদাঙ্গ। এদের প্রয়োজন ব্যবহারিক। এবার বেদের পরিপূরক গ্রন্থ হিসাবে এর বর্ণনা করা যেতে পারে।
ছয়টি বেদাঙ্গের সন্ধান পাওয়া যায়। তাদের প্রথম উল্লেখ পাই ষড়বিংশ ব্রাহ্মণে। সেখানে উল্লেখ আছে “চত্বারোহস্যৈ (স্বাহায়ৈ) বেদাঃ শরীরং ষড়ঙ্গান্যঙ্গানি ৷৷ ৪ ৷৷ ৭” অর্থাৎ চারটি বেদ হল শরীর এবং ছয়টি বেদাঙ্গ হল তাদের অঙ্গ। এই ছয়টি বেদাঙ্গ হল শিক্ষা, ছন্দ, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, জ্যোতিষ এবং কল্প। এদের প্রত্যেকের পরিচয় নীচে দেওয়া হলঃ-
(১) প্রথমে শিক্ষা। সেকালে বেদ অধ্যয়ন নিত্য কর্তব্য ছিল। যজ্ঞেও বেদ পাঠের প্রয়োজন হত। দৈনিক পাঠকে স্বাধ্যায় বলা হত। শিক্ষক বেদের শব্দরাশির নির্ভুল উচ্চারণ শিক্ষা দিত। গুরুর কাছ থেকে শিষ্য তা গ্রহণ করত। বেদের সংহিতা অংশই প্রধানতঃ শিক্ষার আলোচনার বিষয়।
সংহিতা দুভাবে পাঠ করা হত। তার পাঠকে পদপাঠ বলা হত। তা দুরকম হতে পারে। অব্যাকৃত পদপাঠ এবং ব্যাকৃত পদপাঠ। সংহিতায় পরস্পর সন্নিবদ্ধ অবস্থায় যেমন পদগুলি আছে তেমনভাবে ভেখে পাঠ করাকে অব্যাকৃত পদপাঠ বলে। ব্যাকৃত পদপাঠে প্রতি পদকে সন্নিবদ্ধ রূপ হতে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে পৃথকভাবে উচ্চারণ করাকে ব্যাকৃত পদপাঠ বলে। একে শুধু পদপাঠও বলে। সংহিতা পাঠের সঙ্গে পদপাঠের সম্পর্ক নির্দেশ করতে প্রাতিশাখ্য গ্রন্থের উদ্ভব হয়। এগুলি শিক্ষার আদিগ্রন্থ।
প্রত্যেক বেদের সঙ্গে সংযুক্ত প্রাতিশাখ্য সুত্র আছে। ঋগ্বেদের প্রাতিশাখ্য গ্রন্থ হল শাকল প্রাতিশাখ্য। সামবেদের প্রাতিশাখ্য গ্রন্থ অনেকগুলিঃ সামপ্রাতিশাখ্য, পুস্প সূত্র, পঞ্চবিধ সূত্র ও ঋকতন্দ্র ব্যাকরণ। কৃষ্ণ যজুর্বেদের তৈত্তিরীয় প্রাতিশাখ্য সূত্র এবং শুক্ল যজুর্বেদের বাজসনেয় প্রাতিশাখ্য সূত্র। অথর্ববেদের দুটি প্রাতিশাখ্য সূত্রঃ অথর্ববেদ প্রাতিশাখ্য সূত্র এবং শৌনকীয় চতুরধ্যায়িকা।
প্রাতিশাখ্য গ্রন্থগুলি ছাড়াও ছন্দে রচিত কিছু শিক্ষাগ্রন্থ পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে প্রধান হল ঋগ্বেদ ও যজুর্বেদের পাণিনীয় শিক্ষা, সাম্বেদের বারদীয় শিক্ষা, কৃষ্ণ যজুর্বেদের ব্যাস শিক্ষা, শুক্লযজুর্বেদের যাজ্ঞবল্ক্য শিক্ষা এবং অথর্ব বেদের মান্ডুক্য শিক্ষা।
(২) দ্বিতীয় বেদাঙ্গ ব্যাকরণ। ব্যাকরণের সঙ্গে শিক্ষার খানিকটা যোগ আছে। সংহিতার অব্যাকৃত পাঠকে সন্ধিবিচ্ছেদ করে ব্যাকৃতরূপে অর্থাৎ পদপাঠে পরিণত করতে সন্ধির নিয়মগুলি জানা দরকার। সেগুলি ব্যাকরণের বিষয়। অতিরিক্ত ভাবে বেদপাঠে বা যজ্ঞে তার আরও প্রয়োগ গাছে। মন্ত্রকে যজ্ঞে প্রয়োগ করবার সময় কোনও ক্ষেত্রে পদের লিঙ্গ বিভক্তি প্রভৃতির পরিবর্তন ঘটে। ব্যাকরণ না জানলে পদের অর্থগ্রহণ করা সহজ হয় না, ভাষাকে বিশুদ্ধ রাখাও প্রয়োজন। এইসব ক্ষেত্রে ব্যাকরণের প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
দুর্ভাগ্যক্রমে বেদাঙ্গ পদবাচ্য ব্যাকরণ এখন লুপ্ত হয়ে গেছে। তবে ব্যাকরণের ইতিহাস অতি প্রাচীনকাল পর্যন্ত বিস্তৃত। পানিনি তাঁর অষ্টাধ্যায়ী ব্যাকরণে চৌষট্টি জন পূর্বাচার্যের নাম করেছেন। সুতরাং ব্যাকরণ চর্চা বেদের যুগের আদিকাল হতেই প্রচলিত ছিল অনুমান করা যায়।
এই প্রসঙ্গে ঋগবেদের চতুর্থ মন্ডলের ৫৮ সূক্তের ৩ সংখ্যক মন্ত্রটি উল্লেখ করা যেতে পারে। পতঞ্জলি মনে করেন এই মন্ত্রটি ব্যাকরণকে উদ্দেশ্য করে বলা হইয়াছে।
মন্ত্রটি এইঃ চত্বারি শৃঙ্গাঃ ত্রয়োহস্য পাদাঃ দ্বে শীর্ষে সপ্ত হস্তাসো অস্য। ত্রিধা বদ্ধো বৃষভো রোরবীতি মহো দেবো মর্ত্যামাবিবেশ ৷৷ ৪ ৷৷ ৫৮ ৷৷ । এর বাংলা অনুবাদ এই রকম দাঁড়ায়ঃ
এঁর চারটি শৃঙ্গ, তিনটি পাদ, দুটি মস্তক ও সাতটি হস্ত। ইনি অভীষ্টবর্ষী, ইনি তিন প্রকারে বদ্ধ হয়ে অত্যন্ত শব্দ করছেন।
সায়ণাচার্যও একই মত পোষণ করেন। তাঁর ‘ঋগবেদ ভাষ্যোপক্রমণিকায়’ এই মন্ত্রটির একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। চারটি শৃঙ্গ অর্থে এই চারটি পদ আছে। তিনটি পদ হচ্ছে তিন কাল। দুই শীর্ষ হচ্ছে সুবন্ত এবং তিঙন্ত প্রত্যয়। সাতটি হাত হচ্ছে সাতটি বিভক্তি। রোরবীতির অর্থ শব্দকর্মক ধাতু।
(৩) তারপর ছন্দ। ছন্দ শিক্ষার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে যুক্ত। ঋক্ সংহিতার সন মন্ত্রই ছন্দোবদ্ধ। অবশ্য সাম সংহিতার মন্ত্র গাওয়া হত। অথর্ব সংহিতারও বেশীর ভাগ মন্ত্রই ছন্দোবদ্ধ। সংহিতায়, ব্রাহ্মণে এবং উপনিষদে নানা সুত্রে ছন্দের প্রসঙ্গ আছে।
সকল প্রাতিশাখ্যের শেষে সামবেদের নিদান সূত্রে এবং বিভিন্ন অনুক্রমণিকাতে ছন্দ সন্বন্ধে উল্লেখ আছে। পিঙ্গলের ছন্দঃ সূত্রকেই বেদাঙ্গ বলে বিবেচনা করা হয়। তবে এটিকে বিশুদ্ধভাবে বেদাঙ্গ গণ্য করা যায় না। তার প্রথম চার অধ্যায়ে বৈদিক ছন্দের আলোচনা আছে। তারপর অতিরিক্তভাবে লৌকিক ছন্দের ও বিবরণ আছে।
(৪) চতুর্থ বেদাঙ্গ হল নিরুক্ত। নিরুক্তের সঙ্গে নিঘন্টুর ঘনিষ্ঠ সংযোগ আছে। নিঘন্টু হল বৈদিক শব্দের সংগ্রহ। নিঘন্টুর মত তখন আরও অনেক শব্দ সংগ্রহ ছিল। সেগুলি লুপ্ত হয়ে গেছে। যাস্ক নিঘন্টু শব্দের যে ব্যাখ্যা করেছেন তাই নিরুক্ত নামে প্রচলিত।
নিঘন্টুতে তিনটি কান্ডে পাঁচটি অধ্যায় আছে। প্রথম তিনটি অধ্যায় নিয়ে নৈঘন্টুক’ কান্ড। তাতে একার্থবাচক শব্দের সংগ্রহ আছে। চতুর্থ অধ্যায় হল ‘ঐকপদিক’ বা নৈগস কান্ড। তাতে একটি অর্থ সুচিত করে এমন শব্দের সংগ্রহ আছে। পঞ্চম অধ্যায় ‘দৈবত কান্ড’। তাতে বেদের দেবতাদের নামের সংগ্রহ আছে।
নিরুক্তের দুটি ষটকে বারোটি অধ্যার আছে। প্রথম ষতকে নিরুক্তের প্রথম দুটি কান্ডের ব্যাখ্যা আছে। দ্বিতীয় ষটকে দৈবত কান্ডের ব্যাখ্যা আছে।
নিরুক্তের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল ভেঙে বলা। এই অর্থে তা ব্যাকরণের পরিপূরক। ব্যাকরণ শব্দগুলিকে ভেঙে পৃথক করে দেয়। নিরুক্ত পদকে ভেঙে তার ব্যাখ্যা করে। ব্যাকরণের সন্বন্ধ শব্দের সহিত, নিরুক্তের সন্বন্ধ অর্থের সহিত পদকে ভাঙলে তবেই তার অর্থ গ্রহণ করে সহজ হয়। সুতরাং ব্যাকরণ ও নিরুক্ত পরস্পরের পরিপূরক।
(৫) পঞ্চম বেদাঙ্গ হল জ্যোতিষ। যিনি যজ্ঞের অনুষ্ঠাতা তাঁকে ঋত্বিক বলে। যজ্ঞের কাল নিরূপিত হত দিনের বেলায় শুক্লপক্ষ ও উত্তরায়ণকে লক্ষ্য করে। এই প্রসঙ্গে অহোরাত্র, পক্ষ, মাস, ঋতু, অয়ন, সংবৎসর গণনা করা ঋত্বিকের বিশেষ প্রয়োজন পড়ত। এই জন্যই জ্যোতিষের উদ্ভব হয়েছে।
লগধের বেদাঙ্গ জ্যোতিষ নামে একটি গ্রন্থ পাওয়া যায়। যাজুষ এবং আর্চভেদে তার দুটি শাখা আছে।
(৬) ষষ্ঠ বেদাঙ্গ হল কল্প। কল্পগুলি সূত্র আকারে গ্রথিত। তাতে যেমন যজ্ঞের প্রয়োগবিধি বর্ণিত আছে তেমন গার্হস্থ্য জীবনের সংস্কার প্রভৃতির আলোচনা আছে। এদের চারটি শ্রেণী আছেঃ শ্রৌতসূত্র, গৃহ্যসূত্র, ধর্মসূত্র ও শুল্কসুত্র।
ব্রাহ্মণে যে সমস্ত যজ্ঞের উল্লেখ আছে তাদের বলা হয় শৌত যজ্ঞ কারণ ব্রাহ্মণ শ্রুতির অঙ্গ। এই যজ্ঞগুলির সংখ্যা চৌদ্দটি – সাতটি হবির্যজ্ঞ অর্থাৎ ঘৃতাহুতি দিয়ে নিস্পন্ন করতে হয় এবং সাতটি সোম যজ্ঞ অর্থাৎ সোমরস আহুতি দিতে হয়। শ্রৌত সূত্রে এই চৌদ্দটি যজ্ঞের বিবরণ আছে। এর জন্য তিনটি অগ্নির আধান করতে হয়ঃ গার্হপত্য, আহবনীয় ও দক্ষিণ। এদের বিষয়েও আলোচনা আছে।
এই চৌদ্দটি যজ্ঞ ছাড়া আরও অতিরিক্ত যজ্ঞ আছে। তাদের ‘স্মার্ত’ যাগ বলা হয়। তাতে ঔপাসন, হোম, বৈশ্বদেব প্রভৃতি সাতটি যজ্ঞের বিধান আছে। এদের আলোচনা পাই গৃহ্যসূত্রে। স্মার্ত কর্মগুলি স্মার্ত অগ্নিতে করা নিয়ম। স্মার্ত অগ্নির অন্য নাম বৈবাহিক, গৃহ্য, অবিসথ্য ও ঔপাসন অগ্নি। কতকগুলি যজ্ঞের শ্রৌত এবং গৃহ্য উভয় রূপই আছে। যেমন অগ্নিহোত্র, দশপূর্ণমান, পশুযাগ, পিতৃযাগ।
হিন্দুর জীবনে জন্ম হতে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া পর্যন্ত যে দশটি সংস্কার পালন করতে হয় সে বিষয়ে আমরা অবহিত; কারণ বৈদিক যুগ হতে এগুলি এখনও পালিত হয়ে থাকে। যেমন জাতকর্ম, নামকরণ, অন্নপ্রাশন, চুড়াকরণ, কর্ণবেধ, উপনয়ন, সমাবর্তন, বিবাহ, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া। এগুলি কিভাবে সম্পাদিত করতে হবে তার বিধি গৃহ্যসূত্রে আছে। ভাবতে আশ্চর্য লাগে এই সংস্কারগুলি হাজার বছর ধরে অপরিবর্তিত আছে।
ধর্ম সূত্র পরিবারকে ছাড়িয়ে সমাজে পরিব্যাপ্ত। তাতে কর্তব্য অকর্তব্য, দেশাচার-লোকাচার প্রভৃতির বিষয়ে উপদেশ দেওয়া হয়েছে। এর আর এক নাম হল ‘সাময়াচারিক সূত্র। এখানে সময় অর্থে বুঝতে হতে সর্বসম্মত অনুশাসন। সুতরাং তাতে আছে সর্বসম্মত অনুশাসন এবং আচরণ সন্বন্ধে উপদেশ।
তারপর শূল্বসূত্র। তার সঙ্গে কল্পসূত্রের সংযোগ আছে। শুল্ব মানে জমি মাপবার দড়ি। তাতে নানা ধরনের যজ্ঞবেদির পরিমাণ ঠিক করবার নিয়ম দেওয়া আছে। সুতরাং শূল্বসূত্রের সঙ্গে তা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। ঠিক বলতে কি এখানে ভারতীয় জ্যামিতিকে বীজ আকারে পাই।
প্রতি বেদের সঙ্গে সংযুক্ত নানা শ্রেণীর কল্পসূত্র পাওয়া যায়। তাদের একটি তালিকা নীচে দেওয়া হলঃ
ঋগবেদঃ
শ্রৌতসূত্রঃ শাংখ্যায়ন ব্রাহ্মণের সহিত সংযুক্ত শাংখ্যায়ন শ্রৌতসূত্র ও ঐতরেয় ব্রাহ্মণের সঙ্গে সংযুক্ত আশ্বলায়ন শ্রৌতসূত্র।
গৃহ্যসূত্রঃ শাংখ্যায়ন গৃহ্যসূত্র, আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র, শন্বিবৎ গৃহ্যসূত্র। ঋগবেদে ধর্মসুত্র বা শুল্কসূত্র নেই।
সামবেদঃ
শ্রৌতসূত্রঃ পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণের সহিত যুক্ত মশক শ্রৌতসূত্র ও লাট্টায়ন শ্রৌতসূত্র, রাণায়নীয় শাখার দ্রাহ্যায়ণ শ্রৌতসূত্রঃ।
গৃহ্যসূত্রঃ গোভিল গৃহ্যসূত্র, রাণায়নীয় শাখার খাদির গৃহ্যসূত্র ও জৈমিনীয় শাখার জৈমিনীয় গৃহ্যসূত্র। ধর্মসুত্রঃ রাণায়নীয় শাকার গৌতম ধর্মসূত্র। সামবেদের কোন শুল্কসূত্র নেই।
কৃষ্ণ যজুর্বেদ
শ্রৌতসূত্রঃ তৈত্তিরীয় শাখায় দুটিঃ বৌধায়ন শ্রৌতসূত্র, বাধূল শ্রৌতসূত্র, ভারদ্বাজ শ্রৌতসূত্র, আপন্তন্ব শ্রৌতসূত্র, হিরণ্যকেশি শ্রৌতসূত্র, বৈখানস শ্রৌতসূত্র। কাঠক শাখায় কাঠক শ্রৌতসূত্র, মৈত্রায়ণী শাখার মানব শ্রৌতসূত্র এবং বারাহ শ্রৌতসূত্র।
গৃহ্যসূত্রঃ তৈত্তিরীয় শাখার বৌধায়ন, বাধূল, ভারদ্বাজ, আপস্তন্ব, হিরণ্যকেশি ও বৌখানস গৃহ্যসূত্র।
কাঠক শাখায় কাঠক গৃহ্যসূত্র। মৈত্রায়ণেয় শাকার মানব এবং বারাহ গৃহ্যসূত্র।
ধর্মসূত্রঃ তৈত্তিরীয় শাখায় বৌধায়ন, আপস্তন্ব, হিরণ্যকেশি এবং বৈখানস ধর্মসূত্র।
শুল্বসূত্রঃ তৈত্তিরীয় শাখায় বৌধায়ন, আপস্তন্ব ও হিরণ্যকেশি শুল্বসূত্র।
কাঠক শাখায় কাঠক শুল্বসূত্র। মৈত্রায়ণী শাখার মানব এবং বারাহ শুল্বসূত্র। শুল্ক যজুর্বেদঃ
শ্রৌতসূত্র – কাত্যায়ন শ্রৌতসূত্র
গৃহ্যসূত্র – পারস্ক্র গৃহ্যসূত্র
শূল্বসূত্র – কাত্যায়ন শূল্বসূত্র
শুক্ল যজুর্বেদে ধর্মসূত্র নেই।
গৃহ্যসূত্রঃ কৌশিক গৃহ্যসূত্র।
এগুলি অন্য বেদের সূত্রের মত নয়। কৌশিকসূত্রে অনেক তুকতাকের কথা আছে। অথর্ববেদে ধর্মসূত্র ও শুল্বসূত নেই।
কৃতজ্ঞতায়ঃ-
ব্লগ পেইজ ।
No comments:
Post a Comment
Thank you for your message, I see all your messages, it is not possible to reply many times due to busyness, I hope I will reply to everyone in time, thank you for being with me. Thanks you watching my content. Please like, Follow, Subscribe.